নিজস্ব প্রতিবেদক: গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর পরিচয়ে অভিনব কায়দায় প্রতারণা চক্রের মূলহোতা আব্দুল কাইয়ুমসহ সাত জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। উদ্ধার করা হয় সাতটি গাড়ি।
সোমবার (৯ আগস্ট) দুপুরে সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির এলআইসি শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তার ধর।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, করোনাকালে ঢাকা ও পাশের জেলাগুলোতে গার্মেন্টস কোম্পানির নামে গাড়ি ভাড়া করে প্রতারণার মাধ্যমে অন্যত্র বিক্রির ঘটনার অভিযোগ উঠছিল। একাধিক ঘটনা সংঘটিত হলে বিষয়টি সিআইডির নজরে আসে। অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডির এলআইসি শাখা ছায়া তদন্ত শুরু করে।
তদন্তের এক পর্যায়ে জানা যায়, আব্দুল কাইয়ুম ওরফে ছোটন ওরফে ইসতিয়াক ওরফে মেহেদী হাসান গাজীপুরের একটি চার তলা বাড়ির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় একে ফ্যাশনস নামে একটি পোশাক কারখানা স্থাপন করেন। সে সময়ই তিনি ২২টি গাড়ি ভাড়া নেন। পরবর্তীতে গাড়ির মূল মালিকদের অগোচরে প্রতারণার মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ে গাড়িগুলো অবৈধভাবে বিভিন্ন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেন। গাড়ি বিক্রির নগদ তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারক চক্রটি আত্মগোপনে চলে যায়।
এ অবস্থায় গাড়ির প্রকৃত মালিকরা তাদের গাড়ি ও আব্দুল কাইয়ুমের কোনো সন্ধান না পেয়ে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা দায়ের করেন।
পরে সিআইডি তদন্তের মাধ্যমে প্রতারক চক্রটিকে চিহ্নিত করে। এ ঘটনায় মানিকগঞ্জ পৌরসভার শহীদ রফিক সড়ক থেকে আব্দুল আলী মিজি ওরফে আব্দুল হাই (৪৬) ও তার ছেলে নাজমুল হাসানকে (১৯) গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে একটি টয়োটা প্রাইভেটকার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত গাড়ির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রটির প্রধান সহযোগী সানি রহমানকে (২০) দিনাজপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া তথ্যানুযায়ী রংপুরের শাপলা চত্বর এলাকা থেকে সাজরাতুল ইয়াকিন রানাকে (৩৩) গ্রেফতার ও সাদা রঙের এক্সিও প্রাইভেটকার উদ্ধার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যাদি পর্যালোচনা শেষে উত্তরা এলাকা থেকে আরও চারটি চোরাই গাড়ি উদ্ধার করা হয়।
সিআইডির এলআইসির একাধিক টিম ঢাকা ও এর পাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক চক্রটির সক্রিয় সদস্য আলমগীর শেখ (৪৮) ও মো. সেলিমকে (২৭) একটি কালো রঙের এক্সিও প্রাইভেটকারসহ গ্রেফতার করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের মূল হোতা কথিত গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আব্দুল কাইয়ুমের নাম উঠে আসে। কাইয়ুম কক্সবাজারের পেকুয়ার কাছারীমোড়ার মো. আলতাফ হোসেনের ছেলে।
তার সম্পর্কে তথ্য যাচাই-বাছাই করে খুলনার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অবৈধভাবে পাশের দেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে আত্মগোপনে থাকা আব্দুল কাইয়ুমকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
মুক্তা ধর আরও বলেন, আব্দুল কাইয়ুম গাজীপুরে প্রত্যাশা নামে একটি এনজিওতে চাকরি করতেন। সেখানে আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতার কারণে তার চাকরি চলে যায়। এরপর তিনি গাজীপুরের গাছা থানা এলাকায় একটি চার তলা বাড়ির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় একে ফ্যাশনস নামে পোশাক কারখানা স্থাপন করেন। সেখানে তিনি নামমাত্র বেতন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকায় ২১০ শ্রমিককে নিয়োগ দেন।
চলমান করোনা ও লকডাউনের মধ্যে তিনি গার্মেন্টস ব্যবসায় বিদেশি ক্রেতাদের যাতায়াতের কাজে ব্যবহারের কথা বলে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ২২টি গাড়ি ভাড়া নেন। পরবর্তীতে গাড়ির মূল মালিকদের অগোচরে প্রতারণার মাধ্যমে গাড়িগুলো অবৈধভাবে বিভিন্ন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেন। এর আগে তিনি প্রত্যেকটি গাড়ির জিপিএস সিস্টেম অকেজো করে দেন। গাড়ি বিক্রির নগদ তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারক চক্রটি আত্মগোপনে চলে যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তা ধর বলেন, আব্দুল কাইয়ুম ছোটনের এই গার্মেন্টস স্থাপনের মেয়াদ ছিল মাত্র তিন মাস। অর্থাৎ এই স্বল্প সময়ে পণ্য উৎপাদন ও রফতানি করা যায় না। মূলত, প্রতারণার জন্যই তিনি গার্মেন্টস ব্যবসাকে কাজে লাগান। যখন প্রতারণার বিষয়টি ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারেন তখন তিনি যাদের কাছে গাড়ি বিক্রি করেছেন তাদের ঠিকানা দেন। আমরা ভুক্তভোগী ও অন্য আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারি, চক্রটি প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি গাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রতারণা করেছে।
সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, তিনি শুধু ভুক্তভোগীদের সঙ্গেই প্রতারণা করেননি, তিনি যাদের কাছে গাড়ি বিক্রি করেছেন তাদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন। আব্দুল কাইয়ুমসহ অন্য প্রতারকদের বিরুদ্ধে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) গাছা থানায় মামলা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন।
প্রতারক ছোটনের প্রতারণার ফাঁদে নিজের গাড়ি খুইয়েছিলেন ধানমন্ডির অনু চৌধুরী। তিনি বলেন, দুই মাস আগে অফিসে গাড়ি ভাড়া দেয়া হবে মর্মে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। ওই বিজ্ঞাপন দেখেই নিজে বাসায় চলে আসেন প্রতারক ছোটন। তিনি তার গার্মেন্টসে বায়ারদের বহনের জন্য আমার এক্স করোলা গাড়িটি মাসিক ২৭ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। কিন্তু এক মাসের ভাড়াও পাইনি। গাড়িটি নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। পরে ধানমন্ডি থানায় অভিযোগ করি। আজ সিআইডির সহযোগিতায় সে গাড়িটি ফেরত পেয়েছি।
আরেক ভুক্তভোগী মিরপুরের বিউটি আক্তার। তিনি বলেন, মাসিক ৩০ হাজার টাকায় আমার এক্সিও গাড়িটি সহযোগী আমজাদ নামে একজনের মাধ্যমে ভাড়া নেন ছোটন। বলেছিলেন, অফিসে ব্যবহার করবেন। কিন্তু ভাড়া তো দূরের কথা গাড়িটি নিয়েই উধাও হন তারা।
সাননিউজ/ জেআই