চট্টগ্রাম ব্যূরো :
বিনা দোষে কারাভোগ থেকে মুক্তি পাওয়া চট্টগ্রামের সেই মিনু আক্তারের মৃত্যু নিছক সড়ক দুর্ঘটনা নাকি হত্যা, তা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়া মিনুর আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ। সোমবার সকালে সান নিউজকে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, কারাগার থেকে মুক্তির পর মিনুকে সুস্থ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে। পুলিশ বলছে, ভোর চারটার দিকে বায়েজিদ লিঙ্করোডে সড়ক দুর্ঘটনায় মিনু মারা গেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন এত রাতে তিনি ওই জায়গায় কীভাবে গেলেন? পরিবার কেনো তার খোঁজ নেয়নি।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, বিনাদোষে মিনুর কারাগারে থাকার বিষয়টি দেশের সব গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। এটা চট্টগ্রামের বার্নিং ইস্যু, মিনুকে দেখলে যে কারও চেনার কথা। তাহলে বায়েজিদ থানার কেউ কি খবরের কাগজ পড়ে না? তাছাড়া তার মৃত্যুর কথা কাউকে না জানিয়ে কেনো গোপনে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে দিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে দাফন করা হলো? পুরো বিষয়টি অন্য সবার মতো আমার কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে। এসব প্রশ্নের উত্তর বের করতে একটা তদন্ত কমিটি প্রয়োজন বলে মনে করছেন আইনজীবি গোলাম মাওলা মুরাদ।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ২৮ জুন রাত ৩টা ৪০ মিনিটে মিনুর মৃত্যু হয়। মিনুর শরীরের আঘাত থেকে ধারণা করা হচ্ছে গাড়ির ধাক্কায় তার মৃত্যু হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ সড়ক থেকে তার নিথর দেহ উদ্ধার করে।
ওসি বলেন, মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত শেষে তার পরিচয় বের করার সব চেষ্টা করেছি আমরা। গাড়িটিও শনাক্তের চেষ্টা করছি। কিন্তু শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি এখনও। আর পরিচয় না পেয়ে পরদিন আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে তার মরদেহটি দিয়ে দিই। পরে ছবি দেখে তার ভাই মো. রুবেল মিনুকে শনাক্ত করেন। মিনুর খোঁজ খবর না রাখার বিষয়ে রুবেল বলেন, তার বোন মানসিক ভারসাম্যহীন। জেলে থাকার আগেও সে প্রায় সময় বাড়ি থেকে বের হয়ে যেত, আবার আসত। সে রকম মনে করে তার খোঁজ নেওয়া হয়নি। তবে মিনুর মৃত্যুকে তিনিও হত্যাকান্ড বলে দাবি করেন।
রুবেল বলেন, আমার বোনকে যারা ষড়যন্ত্র করে জেলে দিয়েছে। তারাই গোপন তথ্য ফাঁসের ভয়ে নতুন কৌশলে আমার বোনকে হত্যা করতে পারে। এ ঘটনার তদন্ত দাবি করেন রুবেলও।
উল্লেখ্য, বিনা দোষে ৩ বছর জেলে থাকার পর গত ১৬ জুন বিকেল চারটায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান মিনু আক্তার। ওইদিন বেলা আড়াইটার দিকে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঞার আদালত নিরপরাধ মিনুকে মুক্তির আদেশ দেন।
এর আগে ৭ জুন হাইকোর্ট মিনুকে মুক্তির নির্দেশ দেয়। একই সময়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেয় আদালত। তদন্ত শেষে প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রতিবেদন জমা দিলে তার ভিত্তিতে মিনুকে মুক্তির জন্য আদালতে বন্ড দিতে বলা হয়। পরে মিনুর আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বন্ড দিলে মুক্তির আদেশ দেয় আদালত।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জ এলাকায় কোহিনুর আক্তার ওরফে বেবী নামে এক নারী খুন হন। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করা হয়। ওই মামলায় কুলসুম আক্তার নামে এক নারী গ্রেপ্তার হন।
২০০৮ সালে এ মামলায় অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুলসুম আক্তার জামিন পান। এ মামলায় ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত কুলসুম আক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়।
রায়ের দিন আসামি কুলসুম আদালতে অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনু নামের এক নারীকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার সাজিয়ে আত্নসমর্পণ করানো হয়। তখন আদালত মিনুকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়।
২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল কুলসুম আক্তার হাইকোর্টে আপিল করেন। সেই সঙ্গে জামিনের আবেদনও করেন। চলতি বছরের ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি আবেদন করেন। ওই আবেদনে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের ১২ জুন কারাগারে পাঠানো আসামি প্রকৃত সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার নন।
আবেদনের শুনানি শেষে আদালত কারাগারে থাকা মিনুকে আদালতে হাজির করে তার জবানবন্দি নেয়। তখন তিনি জানান, তার নাম মিনু, তিনি কুলসুম নন। মিনু বলেন, মর্জিনা নামের এক নারী তাকে চাল, ডাল দেবে বলে আদালতে এনে জেলে ঢোকান। প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তারকে তিনি চেনেন না।
আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারগুলো দেখে হাজতি আসামি কুলসুম ও সাজা ভোগকারী আসামির চেহারায় অমিল খুঁজে পান। তখন আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারসহ একটি উপনথি হাইকোর্ট বিভাগে আপিল নথির সঙ্গে সংযুক্তির জন্য পাঠিয়ে দেয়। হাইকোর্ট গত ৭ জুন নিরপরাধ মিনুকে মুক্তির নির্দেশ দেয়।
সান নিউজ/ আইকে