সান নিউজ ডেস্ক: এক সময় চালাতো রিকশা চালাতেন ২৭ বছরের রানা। করেছেন দিনমজুরের কাজও। এতে যা আয় হতো তাতে সংসার চলতো টেনেটুনে। এরইমধ্যে আয়ত্ত করে নেন প্রতারণার বিদ্যা। রোজগার ভালোই হতে লাগলো। ছেড়ে দেন দিনমজুরের কাজ এবং রিকশা চালানো।
রানা প্রতারণা করে পেতে থাকেন সফলতা। বছরের মাথায় তার ভেতরে নানা পরিবর্তন আসতে শুরু করে। দামি পোশাক পরা থেকে শুরু করে খাবার খাওয়া, দামি মোবাইল ব্যবহার করা শুরু করেন। এমনকি তার বাড়িতে ভাঙা ঘরের পরিবর্তে আলিশান দালান তৈরির কাজ শুরু করে। হঠাৎ করে রানার ভেতরে এতো পরিবর্তন দেখে বিস্মৃত হন তার স্বজন ও প্রতিবেশীরা। অল্পদিনে কীভাবে নিজের এতো পরিবর্তন করেছে রানা সেটি সম্পর্কে ধারণা ছিল না কারো।
দৃশ্যমান কাজ ছাড়া রাতদিন শুধুমাত্র মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে সময় কাটতো তার। তবে রানার এই আশ্চর্যজনক পরিবর্তনের রহস্য প্রকাশ হতে সময় লাগেনি। ঢাকার কাফরুল থানায় মো. মনসুর রহমান নামের এক ব্যক্তির করা মামলায় রানা গ্রেপ্তারের পর প্রকৃত রহস্য সামনে আসে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের একটি টিম মাসুদ রানাকে গ্রেপ্তার করে জানতে পারে মূলত প্রবাসীদের ইমো আইডি হ্যাক করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করে কোটিপতি বনে গেছে রানা।
সাইবার ক্রাইম সূত্র জানিয়েছে, প্রতারক রানা প্রবাসীদের ইমো আইডি হ্যাক করে তাদের নিকট আত্মীয় যেমন বাবা-মা ও স্ত্রীদের ইমো নম্বরে ফোন বা ম্যাসেজ দিয়ে বলতো আপনার ছেলে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। অথবা আপনার স্বামীকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে টাকা পাঠাতে হবে। এসব কথা শুনে স্বজনরা তড়িঘড়ি করে প্রতারকের দেয়া বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠাতেন। পরবর্তীতে তারা বুঝতে পারতেন কেউ তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এভাবে হাজারখানেক প্রবাসীর আইডি হ্যাক করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রানা।
প্রতারক মাসুদ রানা প্রবাসী রেজুয়ান কবির সাকিবের ইমো আইডি হ্যাক করেছিল গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর। পরে হ্যাক করা আইডি থেকে রানা প্রবাসী সাকিবের দেশে থাকা মায়ের ইমো নম্বরে ফোন দিয়ে বলে তার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তাকে পুলিশ হেফাজত থেকে মুক্ত করতে হলে দেড় লাখ টাকা লাগবে। টাকা পাঠানোর জন্য রানা তাদেরকে ৫টি বিকাশ নম্বরও দেয়। ছেলের ইমো আইডি থেকে ফোন করায় সাকিবের মায়েরও বিশ্বাস হয় ছেলে হয়তো বিপদে পড়েছে। তাই তারা রানার দেয়া ৫টি বিকাশ নম্বরে দেড় লাখ টাকা পাঠিয়ে দেন। তার কিছুক্ষণ পরে ছেলের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় তারা কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে নাটোরের লালপুর থানা এলাকা থেকে রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একইভাবে রানার প্রতারণার শিকার হয়েছেন সৌদি প্রবাসী জাহাঙ্গীর আলম। প্রতারক রানা অন্যান্য প্রবাসীদের সঙ্গে তাকেও একটি গ্রুপে যুক্ত করেছিল। তারপর থেকেই তার মোবাইল ফোনে যখন তখন কল আসতো। মোবাইল ডাটা ওপেন করলে অসংখ্য ম্যাসেজ আসতো। এসব কারণে অনেকটা বিরক্তবোধ করতেন জাহাঙ্গীর আলম। পরে প্রতারক রানা গ্রুপে ম্যাসেজ দিয়ে বলতো যারা এই গ্রুপ থেকে বের হতে চান তাদের মোবাইলে একটি ম্যাসেজ যাবে। ওই ম্যাসেজে একটি নম্বর থাকবে। সেই নম্বরটা দিলেই গ্রুপ থেকে বের হওয়া যাবে। সহজ সরল অনেক প্রবাসী না বুঝেই ওটিপি নম্বরটি রানাকে দিতেন। তারপরই তাদের আইডি হ্যাক হয়ে যেত। ঠিক একইভাবে জাহাঙ্গীর আলমও তার মোবাইলে যাওয়া ওটিপি নম্বর দিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। রানা তার স্ত্রীর মোবাইলে ফোন দিয়ে জানিয়েছিল সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় জাহাঙ্গির মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। জরুরি অস্ত্রোপাচারের জন্য দুই লাখ টাকা প্রয়োজন। পরে রানার দেয়া ৭টি বিকাশ নম্বরে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী সেই টাকা পাঠিয়ে দেন। অথচ রাতে সুস্থ সবল জাহাঙ্গীর তার স্ত্রীকে ফোন করে ইমো আইডি হ্যাকের বিষয়টি জানান।
সাইবার ক্রাইম সূত্র জানিয়েছে, বিদেশে শ্রমিক পর্যায়ে কাজ করেন এমন অনেক প্রবাসী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন আইডি কীভাবে নিরাপদ রাখতে হয় সে বিষয়ে তাদের জ্ঞান কম। আর এই সুযোগে মাসুদ রানার মতো কিছু চক্র তাদের টার্গেট করে। বেশ কয়েকটি চক্র বহু বছর ধরে এমন প্রতারণা করে আসছে। কিন্তু বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন না। তারা মনে করেন যা হবার তা হয়ে গেছে এখন থানা পুলিশ করে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হবে না। আর ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করার প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এছাড়া প্রতারকরা যেসব বিকাশ নম্বর দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে টাকার লেনদেন করে সেগুলোও প্রতারণার মাধ্যমে করা। কুড়িয়ে পাওয়া অথবা চুরি করা ভোটার আইডি কার্ড ব্যবহার করে তারা বিকাশ নম্বর রেজিস্ট্রেশন করে। একারণে লেনদেনের নম্বর দিয়ে প্রতারকদের ধরা সম্ভব হয় না। প্রতারক মাসুদের কাছ থেকে ২১টি ভুয়া নিবন্ধিত সিম ও ৯টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছে সাইবার টিম।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তিন বছর আগে রানা রাতদিন রিকশা চালাতো। অভাব অনটনে দিন মজুরের কাজ করতো। কিন্তু ইমো আইডি হ্যাকের কৌশল আয়ত্ত করে রাতারাতি ধনী হয়ে যায়। অভাব অনটনের সংসারে যেখানে দুবেলা খাবারই জুটতো না সেখানে রানা চলাফেরা ও বাড়িঘর দেখলে যে কেউ অবাক হবে। তার রাতারাতি ধনী হওয়ার ঘটনায় প্রতিবেশীরাও অবাক। দৃশ্যমান কোনো কাজকর্ম ছাড়া কীভাবে এতো টাকার মালিক হয়েছে রানা সেটি কারো চিন্তাতেও আসেনি। সূত্রগুলো বলছে, রানার বিরুদ্ধে আগেও প্রতারণার মামলা ছিল। সে একাই এই কাজ করতো নাকি তার সঙ্গে আর কেউ জড়িত আছে সে বিষয়েও খোঁজখবর নিচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল হক বলেন, কয়েক বছর ধরে প্রবাসীদের ইমো আইডি হ্যাক করে মাসুদ রানা প্রতারণা করে আসছিল। কৌশলে আইডি তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যদের মেসেজ পাঠাতো বা কল করতো। তারপর নানা টালবাহানায় টাকা নিতো। সুনির্দিষ্ট ভুক্তভোগীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েই আমরা তার সম্পৃক্ততা পেয়েছি। সে আমাদের কাছে স্বীকার করেছে বহু প্রবাসীর সঙ্গে এরকম প্রতারণা করেছে। প্রতারণার টাকা নিয়ে কম সময়েই নিজের ও পরিবারের মধ্যে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা বাংলাদেশিরা মূলত ইমো আইডি ব্যবহার করে পরিবার পরিজনের সঙ্গে কথা বলে। আর রানা প্রবাসীদের টার্গেট করে এমন প্রতারণা করতো। তাই ইমো আইডি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। অপরিচিত কেউ গোপন পিন নম্বর চাইলে এড়িয়ে চলতে হবে। বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত করলে সেটি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।