মাহমুদুল আলম: সাতক্ষীরার তালা উপজেলার সুভাষিনীতে অবস্থিত সৈয়দ দিদার বখ্ত মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নেছার আলীর বিরুদ্ধে আসা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। বিদ্যালয়ে একজন আয়া নিয়োগে দুই প্রার্থীর কাছ থেকে ওই শিক্ষক মোট ১৫ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ তুলে ধরে সাননিউজ – এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর মাউশি থেকে সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিসারের প্রতি এই নির্দেশ যায়।
তবে তদন্তের নির্দেশ হলেও তদন্তের আগেই বেতন দিয়ে দেয়া হয়েছে আয়া তাছলিমা আক্তারকে। যার কাছ থেকে ১১ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে, নিয়োগ প্রক্রিয়ার পদে পদে অনিয়ম করে প্রধান শিক্ষক তাকে চাকরি দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ডিসি থেকে মাউশি পর্যন্ত সব জায়গায়। মাউশি থেকে জেলা শিক্ষা অফিসারের প্রতি তদন্তের নির্দেশ হওয়ার পর গত সপ্তাহে তার বেতন হয়েছে বলে প্রধান শিক্ষক নিজে সাননিউজকে নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে মাউশি সূত্রে জানা গেছে, সাত কার্যদিবসের মধ্যে সরেজমিনে গিয়ে এই বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়েছে অধিদপ্তর। মাউশির এই চিঠি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিসার এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন। গত ৪ এপ্রিল বিকেলে সাননিউজ কে তিনি বলেন, আমি মাত্রই চিঠিটি পেয়েছি।
এর পরের দিন থেকে সারাদেশে লকডাউন। তাহলে এই ‘সাত কার্যদিবস’ কি লকডাউন শেষে অফিস খোলার প্রথম দিন থেকে কাউন্টডাউন হবে? এই প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘তাই তো হওয়া উচিত’।
উল্লেখ্য এর আগেও এই একই জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এই বিষয়ে তদন্ত করেছিলেন। তদন্তকালে প্রধান শিক্ষকের কণ্ঠের অডিও রেকর্ড, টাকা উত্তোলন সংক্রান্ত ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং টাকা লেনদেনে উপস্থিত দুই সাক্ষীর লিখিত ও মৌখিক বক্তব্যে প্রধান শিক্ষকের টাকা গ্রহণের সত্যতা পেয়েছেন খোদ জেলা শিক্ষা অফিসার। মাউশিকে জেলার সর্বোচ্চ শিক্ষা কর্মকর্তার দেয়া লিখিত ওই তদন্ত প্রতিবেদনে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়।
গত বছরের ১৮ জুন স্বাক্ষরিত সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিসারের লেখা প্রতিবেদনটি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, মাউশি পরিচালক ও উপ-পরিচালক (খুলনা অঞ্চল) এবং সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে এই প্রতিবেদন পাঠান। মাউশির উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিনের দপ্তরে এ সংক্রান্ত লিখিত অভিযোগ গেলে বিষয়টিকে তিনি ‘ভিভিআই’ বলে নোটও দেন তখন।
অবশ্য এসব পাশ কেটে যান প্রধান শিক্ষক। আয়া পদে চাকরি দেয়ার কথা বলে যে তাছলিমা আক্তারের কাছ থেকে ১১ লাখ টাকা নিয়েছেন, তাকেই চাকরিটা দিয়েছেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর তাছলিমা আক্তারকে নিয়োগ পত্র দেন প্রধান শিক্ষক মো: নেছার আলী। তবে চাকরি দেননি, এমনকি টাকাও ফেরত দেননি একই পদের আরেক প্রার্থী উম্মে হাবীবাকে। যাকে আট লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি দেবেন বলে নগদ চার লাখ টাকা নিয়েছিলেন তিনি। তাছলিমা আক্তারকে নিয়োগ দেয়া প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর করা নিয়োগ পত্রটির একটি কপি আছে সাননিউজের কাছে। এতে তিনি এর আগের ৩ সেপ্টেম্বরের নেয়া লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয় বলে উল্লেখ করেন।
তবে ওইদিনের নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলের সীট এবং রেজুলেশন বইয়ের কপিও সাননিউজের কাছে আছে। ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রস্তুত করা ওই চূড়ান্ত ফলাফল সীটে উল্লেখ করা আছে যে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা আরেক প্রার্থী উম্মে হাবীবার মোট প্রাপ্ত নম্বর ১৬। কিন্তু বিদ্যালয়ের একইদিন ৩ সেপ্টেম্বরের রেজুলেশনে উম্মে হাবীবা ১৪ পেয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য একই দিনের উভয় কাগজে স্বাক্ষর আছে প্রধান শিক্ষক মো: নেছার আলীর।
যদিও উম্মে হাবীবার আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই দিনের সেই পরীক্ষাই স্থগিত হয়। ওই পরীক্ষায় ডিজি প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তালা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক বদরুজ্জামান। তার বরাবর উম্মে হাবীবা সুবিচার চেয়ে একটি আবেদন করেন সেদিন। আবেদনের বিষয় ছিল ‘প্রার্থীর আত্মীয়স্বজন দ্বারা সাজিয়ে নিয়োগ বোর্ড করা প্রসঙ্গে’। সাননিউজের কাছে আসা আবেদনের কপিতে দেখা যায়, ইতপূর্বে শিক্ষা অফিসারের দেয়া তদন্ত রিপোর্ট এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও স্বাক্ষীদের লিখিত বক্তব্যের কপিও আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ‘পরীক্ষা স্থগিত করা হল’ বলে ৩ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষর করেন বদরুজ্জামান।
আবার পরীক্ষায় ডিজির প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত না থেকেও চূড়ান্ত ফলাফল সীটে স্বাক্ষর করেন তালা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অলোক কুমার তরফদার। সেখানেও একই তারিখ ৩ সেপ্টেম্বর দেয়া আছে।
এ বিষয়ে উম্মে হাবীবার স্বামী মো: আব্দুল্লাহ আল-মামুন (রিপন) সাননিউজকে বলেন, ‘অলোক বাবু (অলোক কুমার তরফদার) পরীক্ষার দিন উপস্থিতই ছিলেন না। তিনি তিন মাস পর ব্যাকডেট দিয়ে এই কাগজে স্বাক্ষর করেছেন। উপস্থিত ছিলেন বদরুজ্জামান সাহেব। সেই ভিডিওও আমাদের কাছে আছে।‘
উল্লেখ্য ৩ সেপ্টেম্বরের ওই পরীক্ষায় অনিয়ম হতে পারে- তার ‘আভাস’ পেয়ে আগেই সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ও তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন উম্মে হাবীবা। পরীক্ষার ১৫ দিন আগে ২০২০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর লেখা ওই আবেদনের বিষয় ছিল ‘সৈয়দ দিদার বখ্ত মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের আয়া পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও আমার মৌলিক অধিকার রক্ষা প্রসঙ্গে।‘
আবেদনে তিনি লিখেন, ‘সৈয়দ দিদার বখত মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের আয়া পদে নিয়োগের নিমিত্তে বিগত ২২.১১.২০১৭ এবং সর্বশেষ ০৩.০৭.২০২০ (চতুর্থ বার) তারিখে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। আমি উম্মে হাবীবা একজন প্রার্থী হিসাবে আবেদন করি। ১৬.০২.২০২০ তারিখে আমাকে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্য চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আমি জানতে পারি যে উপরে উল্লেখিত স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব নেসার আলী অর্থের বিনিময়ে সাজানো নিয়োগ বোর্ড গঠন করে তার পছন্দ মতো প্রার্থী তাসলিমাকে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করছেন। আমি উক্ত অনিয়মের বিষয়টি লিখিত ভাবে অবহিত করি। তদপ্রেক্ষিতে নিয়োগ বোর্ড স্থগিত করা হয়।‘
আবেদনে তিনি আরও লিখেন, ‘বর্তমানে উক্ত নিয়োগ বোর্ড স্থগিত থাকা সত্ত্বেও স্কুল কমিটি পুনরায় ৩.৯.২০২০ তারিখে সাজানো নিয়োগ দেয়ার প্রচেষ্টা করেন। এ সময়ও আমি ডিজি প্রতিনিধি হিসেবে আগত কর্মকর্তাকে সাজানো নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করি। তিনি আমার অভিযোগ গ্রহন করে নিয়োগ সীটে স্বাক্ষর করবেন না মর্মে আমাকে মৌখিকভাবে আশ্বাস দিয়ে চলে যান। বর্তমানে বিষয়টি গোপন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলতে পারেন এমন আভাষও পাওয়া যাচ্ছে।‘
এই আবেদনের কপিও সান নিউজের কাছে আছে। যাতে দেখা যায়, গত ২৫ অক্টোবর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং ২৮ অক্টোবর জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় তা গ্রহণ করে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর ডিজি প্রতিনিধি বরাবর যে আবেদনের মাধ্যমে উম্মে হাবীবা পরীক্ষা স্থগিত করিয়েছিলেন, তাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি সৈয়দ দিদার বখত বালিকা বিদ্যালয়ে একজন আয়া পদে নিয়োগ প্রত্যাশি। কিন্তু আমার প্রতিবেশি তাসলিমা স্বামী আ: হামিদকে নিয়োগ নেওয়ার জন্য তাসলিমার নিজের বোন ও মামাতো বোন সহ তিনজন আত্মীয় স্বজন দ্বারা নিয়োগ বোর্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে আমি আপনার নিকট সুবিচার দাবী প্রার্থী।‘ এর পর ডিজি প্রতিনিধি ‘পরীক্ষা স্থগিত করা হল’ বলে স্বাক্ষর করেন।
এই আবেদনের সঙ্গে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুনের লেখা তদন্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়। গত ৩০ জুন ওই তদন্ত প্রতিবেদন দেন সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিসার এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন। প্রতিবেদনে তিনি লিখেন, ‘তালা উপজেলাধীন সৈয়দ দিদার বখত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব মো: নেছার আলী এর বিরুদ্ধে আয়া পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এক জন প্রার্থীর সাজানো নিয়োগ বোর্ড স্থগিত ও প্রদানকৃত টাকা ফেরত পাবার মর্মে অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিস কক্ষে বাদী, বিবাদী ও স্বাক্ষীগণের উপস্থিতিতে তদন্ত করা হয়। বক্তব্য ও কাগজপত্রাদি যাচাইপূর্বক নিম্নে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো-
বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে নিয়োগ বোর্ড স্থগিত করা হয়। আয়া পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য প্রধান শিক্ষকের সাথে প্রার্থী উম্মে হাবিবার সঙ্গে আট লাখ টাকা চুক্তি হয় এবং অগ্রীম চার লাখ টাকা লেনদেন হয় স্বাক্ষীদ্বয়ের উদ্বৃতি অনুযায়ি। পরবর্তীতে বিদ্যালয়ে বিল্ডিংয়ের কাজ সম্প্রসারিত করতে পার্শ্ববর্তী জমি বর্তমান চেয়ারম্যান দিতে শর্ত সাপেক্ষে রাজি হয়। সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠান প্রধান বাদীর জমি দানের পূর্ববিবাদের জের ধরে টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে।‘
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রতিবেদনে আরও কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘১. ছয় মিনিটের একটি অডিও রেকর্ড অনুযায়ি প্রধান শিক্ষকের টাকা গ্রহণের বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা মেলে। ২. বাদী জনাব মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন রিপন এর ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যাংক হিসাব নম্বর ২০৫০১৪৩৬৭০০০২৪৬০০ যার ব্যাংক স্টেটমেন্ট অনুযায়ী ঐ দিন ব্যাংক থেকে চার লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়। ৩. টাকা লেনদেনের সময় উপস্থিত ২ জন স্বাক্ষীর লিখিত ও মৌখিক বক্তব্যে টাকা গ্রহণের বিষয়টির সত্যতা মেলে।‘
প্রসঙ্গত, গত ১৯ আগস্ট তারিখে সাতক্ষীরা সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে দাখিল করার সিলযুক্ত ব্যাংক স্টেটমেন্টের এই নথিটি সাননিউজের কাছেও আছে। তাতে দেখা যায় ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি এই টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়।
আদালতে দাখিল করা সিলযুক্ত এই লেনদেন সংক্রান্ত আরেকটি নথিও সাননিউজের কাছে আছে। এতে মো: আব্দুল মালেক সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ‘চাকুরী দেওয়ার জন্য আয়া পদে আমার সামনে নগদ ৪০০০০০ (চার লক্ষ) টাকা দিয়া দেয় হেড মাষ্টার নিছার টাকাটা গুনে বুঝ করিয়া নিয়া নেয়।‘ আদালতে দাখিল করা আরেকটি নথিতে দেখা যায় স্থানীয় আরেক স্বাক্ষী মো: সোহরাব হোসেনও লেনদেন হয়েছে বলে সাক্ষ্য দেন।
উম্মে হাবীবার স্বামী মো: আব্দুল্লাহ আল-মামুন (রিপন) সাননিউজকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার সৈয়দ দীদার বখত মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের আয়া পদে চাকুরির জন্য দরখাস্ত করে। দীর্ঘ দিন ধরে প্রধান শিক্ষক নেছার আলী বিভিন্ন অজুহাতে সময় পার করতে থাকেন। নানা অজুহাতে প্রথম বার বিজ্ঞপ্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে দ্বিতীয়বার আবার বিজ্ঞপ্তি দেন। সেটিরও মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর তৃতীয়বার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এবং আমার স্ত্রী উম্মে হাবীবাকে নিয়োগ দেওয়ার শর্তে গতবছর ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি আমার কাছ থেকে নগদ চার লাখ টাকা নেন।
দুইজন স্বাক্ষীর সামনে সৈয়দ দীদার বখত মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমার কাছ থেকে এই টাকা নেন। কিন্তু পরবর্তীতে ঐ (আয়া) পদে অন্য একজন প্রার্থী তাছলিমাকে নিয়োগ দেবেন বলে এগার লাখ টাকার চুক্তি করেন প্রধান শিক্ষক। এর ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য মোট ১০ জন প্রার্থীকে চিঠি দেন। এর মধ্যে আটটি চিঠি বিতরণ হয় এবং বাকি দুইটি প্রধান শিক্ষকের কাছে ফেরত আসে।
পরদিন ১১ ফেব্রুয়ারি আমার স্ত্রী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে প্রধান শিক্ষকের কাছে ওই চার লাখ টাকা ফেরত চাই। কিন্তু টাকা ফেরত না দিয়ে তিনি তাছলিমাকে নিয়োগ দেয়ার জন্য কার্যক্রম শুরু করেন। এ অবস্থায় নিয়োগ পরীক্ষার দিন ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে আমার স্ত্রীকে নিয়োগ দেবে বলে নেয়া টাকা ফেরত এবং অন্য একজনকে নিয়োগ দেয়ার জন্য সাজানো নিয়োগ বোর্ড স্থগিত করার জন্য এমপি সাহেব, জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা চেয়ারম্যান বরাবর আমার স্ত্রী দরখাস্ত করে।
ওই দিন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য তাছলিমা এবং তার সাজানো দুই প্রার্থী সাবিনা ও শামিমা সুলতানা হাজির হন। তবে নিয়োগ বোর্ড স্থগিত হয়ে যাবার কারণে পরীক্ষা হয় না। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিষয়টি তদন্ত করার জন্য জেলা শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশ দেন।‘
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সাংসদ মুস্তফা লুৎফুল্লাহ সাননিউজকে বলেন, ‘না, আমাকে এই বিষয়ে কেউ কিছু জানায়নি। আমি জানি না। জানলে আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা শিক্ষা অফিসারকে ব্যবস্থা নিতে বলতাম। তবে এমন অনিয়ম যদি হয়ে থাকে তাহলে শুধু প্রধান শিক্ষক নন, ডিজি প্রতিনিধি বা যেই জড়িত থাক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে দুদকসহ প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। তাহলে অনেক মানুষের উপকার হবে। দৃষ্টান্তমূলক একটা ব্যবস্থা নেয়া হলে অনেক অনিয়ম বন্ধ হয়ে যাবে।‘
বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দিদার বখতের কাছে জানতে চাইলে এ বিষয়ে তিনি বলেন, এই নিয়োগ নিয়ে একটা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। এটি বছর দুয়েক আগের কথা। তবে এরপর আর কী হয়েছে, আমি জানি না।
ঢাকায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরে এই বিষয়ে কথা হয় উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিনের সঙ্গে। গত ৭ মার্চ সাননিউজের সঙ্গে এই বিষয়ে তার দপ্তরে কথা হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সহকারী পরিচালক কাওছার আহমেদ। এই কর্মকর্তা উপ-পরিচালক (ডিডি) আজিজ উদ্দিনকে জানালেন, তিনি যে অঞ্চলের দায়িত্বে আছেন, সাতক্ষীরা তার অন্তর্ভূক্ত। তখন তিনি কর্মকর্তা কাওছার আহমেদের কাছ থেকে এই বিষয়ে জানার জন্য বলেন।
এরপর কাওছার আহমেদ নিজ কক্ষে গিয়ে বিষয়টি শোনেন। তারপর বললেন, আমি মাত্রই এই অঞ্চলের দায়িত্ব নিয়েছি, এটি ওই সময় দেখতেন শিক্ষা অফিসার (মাধ্যমিক-১) চন্দ্র শেখর হালদার।
পরে চন্দ্র শেখর হালদারের কার্যালয়ে গেলে তিনি এই বিষয়ে তথ্য দেয়ার জন্য কম্পিউটার অপারেটর মো. মাহবুবুর রহমানকে দায়িত্ব দেন।
মাহবুবুর রহমান দাবি করেন, সাতক্ষীরা শিক্ষা কর্মকর্তার পাঠানো এ সংক্রান্ত কোন তদন্ত প্রতিবেদন ডিডির দপ্তর পায়নি। তবে উম্মে হাবীবা তার এ সংক্রান্ত একটি আবেদনের অনুলিপি ডিডির দপ্তরেও পাঠিয়েছেন।
নথিটি দেখিয়ে মাহবুবুর রহমান সাননিউজকে বলেন, “যদিও আবেদনটি মাউশি বরাবর করা হয়নি, অনুলিপি দেয়া হয়েছে, তবে ডিডি (মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন) স্যার এতে ‘ভিভিআই’ লিখে নোট দিয়েছেন। বর্তমানে ফাইলটি মাউশির ডিজি (প্রফেসর সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক) স্যারের দপ্তরের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় আছে।“
প্রসঙ্গত হাবীবার স্বামী একটি অডিও রেকর্ড সরবরাহ করেন সাননিউজকে। এতে হাবীবার স্বামী এবং প্রধান শিক্ষকের মধ্যে নিয়োগসংক্রান্ত লেনদেন নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। এতে হাবীবার স্বামী এক সাথে পুরো আট লাখ টাকা দিতে পারবেন না, তাই বাকি চার লাখ টাকা পরে দেবেন বলে প্রধান শিক্ষকের কাছে সময় চেয়ে অনুনয় করেন। আর অন্য পরীক্ষার্থী আরও বেশি টাকা দিতে রাজি বলে হাবীবার স্বামীকে প্রধান শিক্ষকের কণ্ঠে জানান দিতে শোনা যায়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক সাননিউজকে বলেন, ‘নিয়োগ দেয়ার কি ক্ষমতা আছে আমার! আমি বোর্ড গঠন করে দিয়েছি। নিয়ম অনুযায়ী বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে।‘
বোর্ড গঠন করার ক্ষমতা আপনার, আপনি বোর্ড গঠন করেছেন, যিনি নিয়োগ পেয়েছেন, তার আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে আপনি বোর্ড গঠন করেছেন বলে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আরেক প্রার্থীর অভিযোগ আছে।
এটি মনে করিয়ে দিলে, এই অভিযোগ অস্বীকার করেননি প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘আমি বোর্ড গঠন করে দিয়েছি। কে কার আত্মীয়, তা তো দেখার দরকার নেই।‘
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, না। (নিয়োগ পরীক্ষায়) তাছলিমার (যিনি নিয়োগ পেয়েছেন) আত্মীয় কে আছেন, কে নাই। সেটা তো বিষয় না।‘
টাকা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি প্রধান শিক্ষক। আমার ক্ষমতা হলো বোর্ড গঠন করে দেওয়া। আমি কি নিয়োগ দিতে পারি!’ তিনি বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে কোন টাকা পয়সা নিইনি। আর আমার জীবনে এ রকম কোন রেকর্ড নেই। ওরাই জানে, ওরাই কী করে, ওরাই বলছে ওটা।‘
‘আর আমি কেন আত্মীয়-স্বজন দিয়ে, টাকা-পয়সা নিয়ে (বোর্ড গঠন করে) করতে যাব! আমার কী লাভ আছে! এ বিষয়ে আমার কোন হাত নাই।‘ – দাবী করেন প্রধান শিক্ষক।
সাননিউজ/বিএস