নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ থেকে অবৈধ ভাবে বিদেশে অর্থ পাচার এবং এসব অর্থ নিয়ে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার প্রতিরোধে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন ও উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার কাছে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে।
আইন অনুযায়ী অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করে বিচারিক কার্যক্রম শুরুর জন্য দেশের পাঁচটি সংস্থা দায়িত্বপ্রাপ্ত। এসব সংস্থার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্তে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন সংস্থার কাছে ৩ হাজার ২২৮টি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। এর বাইরে আরও ১৭৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিদেশ থেকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা সরবরাহ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিকে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে গত পাঁচ বছরে বিদেশে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন সংশ্লিষ্ট ৫৭২টি প্রতিবেদন দুদকে পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। এ সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনের সংখ্যা ২৯১টি, সিআইডিতে ১ হাজার ৬৬৪, এনবিআর-এ ১৭৮ ও অন্যান্য সংস্থায় পাঠানো প্রতিবেদনের সংখ্যা ৫২৩টি।
২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করার ঘটনা দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করে থাকে। বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা তদন্ত করে এনবিআর। আর হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ পাচার হলে তা পুলিশের সিআইডি তদন্ত করে।
অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয় ২০১২ সালে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর এ আইন সংশোধন করা হয়। আইন অনুযায়ী, বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়মবহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচার মানিলন্ডারিং অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত।
তবে বিভিন্ন গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি পণ্যের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য পরিশোধ (ওভার ইনভয়েসিং) ও রফতানি মূল্যের চেয়ে কম দেখিয়ে প্রকৃত মূল্য দেশে প্রত্যাবাসিত না করা (আন্ডার ইনভয়েসিং), আমদানীকৃত পণ্য দেশে না আনা বা কম আনা এবং হুন্ডিসহ বিভিন্ন উপায়ে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়া ক্রস বর্ডার ক্যাশ স্মাগলিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার সংঘটিত হয়।
তবে আইনের কঠোর বিধি-বিধানও অর্থ পাচার বন্ধ করতে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)। জিএফআইয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রফতানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার নজিরও রয়েছে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন দফায় সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে থাকা আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ফেরত আনা হয়েছে।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আইনগত সহযোগিতা নিশ্চিত করতে ২০১২ সালে পারস্পরিক সহায়তা আইন করা হয়। এ আইনের আওতায় অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা প্রদানে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।
জানা গেছে, বিদেশে অর্থ পাচার শনাক্ত হওয়ার ঘটনাগুলোতে সংশ্লিষ্ট অর্থ পুনরুদ্ধারেরও উদ্যোগ নেয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিএফআইইউ। এজন্য বিদেশে সংশ্লিষ্ট কাউন্টারপার্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। তবে অর্থ ফেরত আনার বেশকিছু দৃষ্টান্ত থাকলেও তা অর্থ পাচারের তুলনায় খুবই সামান্য।
বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনতে এটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স কাজ করছে। সিঙ্গাপুরে পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে মূল ভূমিকা পালন করেছে এ টাস্কফোর্স।
অর্থ পাচারের উদ্ঘাটন ও আইনি কার্যক্রম গ্রহণে অন্যতম সংস্থা দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দুদকের অবস্থান সবসময়ই কঠোর। অর্থ পাচারের ঘটনা উদ্ঘাটন ও শাস্তি সুনিশ্চিত করতে দুদকের মানিলন্ডারিং ও গোয়েন্দা ইউনিট রয়েছে।
বেশকিছু আর্থিক অপরাধ প্রমাণে দুদক দেশের বাইরে তথ্যের খোঁজে চিঠি দিয়েছে। অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। বিদেশে পালিয়ে গিয়েও রক্ষা পাবেন না তারা। অর্থ পাচারে জড়িতদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
সান নিউজ/এসএ