নিজস্ব প্রতিবেদক : মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রগুলো মাদকমুক্ত করার পরিবর্তে চলছে জমজমাট মাদক ব্যবসার হাট। সেখানে ইয়াবা থেকে শুরু করে সব ধরনের মাদকের ছড়াছড়ি। দীর্ঘদিন থেকে মাদক বিক্রির আখড়ায় পরিণত হয়েছে রাজধানীর অনেক মাদক নিরাময় কেন্দ্র। মাদক নিরাময় কেন্দ্রকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার মাদক বাণিজ্য হচ্ছে।
আর এই নিরাময় কেন্দ্রগুলোর ক্রেতা স্থানীয় বখাটে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে নানা শ্রেণির পেশার মানুষ। সব কিছু জেনেও ব্যবস্থ নিচ্ছে না মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। নিয়মিত মাসোহারায় সব জায়েজ। অন্যদের ম্যানেজ করতে স্থানীয় মাস্তানদের দেয়া হয় নানা সুবিধা।
চাঞ্চল্যকর এসব ঘটনার তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে প্রতিবেদকের সরেজমিন অনুসন্ধানে। দিনভর এ অভিযানে একাধিক মাদক নিরাময় কেন্দ্র ঘুরে গা শিউরে ওঠার মতো অবিশ্বাস্য সব তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, অনুমোদন নিয়েছে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের।
অথচ সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে মানসিক হাসপাতালের। ১০ বেডের অনুমতি নিয়ে রোগী ভর্তি করছে অর্ধশতাধিক কোথাও অনেক বেশি। নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই, এখানে-সেখানে পড়ে আছে রোগী। অভিযানের তথ্য ফাঁস হওয়ার পরও তারা তড়িঘড়ি করে সবকিছু গোছগাছ করে উঠতে পারেনি। তাতেও যা দেখা গেছে, সবই ছিল ফৌজদারি অপরাধের আলামত।
এছাড়া এসব কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক নিয়োগের নামে চলছে এক রকম নৈরাজ্য। ডাক্তার আছে খাতা-কলমে। বাস্তবে নিয়ম মেনে ডাক্তার-নার্স কিছুই নেই। কিছু অখ্যাত ডাক্তার ভাড়া খাটছে পালা করে সব মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। কেউ কেউ পর্দার আড়ালে এসব হাসপাতালের প্রধান ক্রীড়নক। ওষুধ-পথ্য বলতেও তেমন কিছু নেই।
কোথাও দেখা গেছে, লোক দেখানোর জন্য ওষুধের খালি প্যাকেট সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আদাবরে মাইন্ড এইড নামের নিরাময় কেন্দ্রে পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর দেশজুড়ে নিরাময় কেন্দ্রগুলো ঝটিকা পরিদর্শন শুরু করেছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ১৩ নভেম্বর থেকে এ অভিযান শুরু হয়েছে।
শুক্রবার বেলা ২টা ৪১ মিনিট। নিউ ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, গোলারটেক, পালপাড়া মিরপুর। চারতলা জরাজীর্ণ ভবন। ভেতরে ঢুকতেই নিচ তলায় ছোট একটি অফিসকক্ষ। নির্বাহী পরিচালক আকরাম হোসেন তালুকদার আরাম করে ধূমপান করছেন। হঠাৎ আগন্তুক দেখে হতচকিত হয়ে গেলেন। বললেন, আপনারা কে? মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে এসেছি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে নির্যাতন চালানোর জন্য আছে নিয়োগপ্রাপ্ত বাউন্সার। পরিদর্শন চলাকালে সন্ধ্যা ৬টার দিকে সাদা পাঞ্জাবি পরে ঘটনাস্থলে হাজির হন স্থানীয় এক যুবক। নাম মিয়া মো. মাকসুদ। স্থানীয় এমপি আসলামুল হকের মামা হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘এ কেন্দ্র ভালো চলছে। মহল্লার লোক হিসেবে আমরা এটার দেখভাল করি।’
এরপর উত্তর বিশিল এলাকার ৭ নম্বর রোডের ৫৯/ক প্লটে অবস্থিত ব্রাদার্স মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে আরও ভয়াবহ অবস্থা দেখা যায়। নিরাময় কেন্দ্রটির নিচ তলায় গার্মেন্ট কারখানা। চেয়ারম্যানের নাম মনির হোসেন। কিন্তু তিনি ভিজিটিং কার্ডে লিখেছেন ব্রাদার্স মানব কল্যাণ সংস্থা। এ প্রতিষ্ঠানেরও লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ।
চেয়ারম্যানের হাতে ৬০ হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোন। অথচ তিনি বললেন, টাকার অভাবে লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেননি। এখানেও ডাক্তার বা নার্সের দেখা মেলেনি। তবে যথারীতি নিরাময় কেন্দ্রের সংশ্লিষ্টদের দাবি, সবই আছে তাদের।
কিন্তু দেখা যায়, কেন্দ্রে প্রায় ১২ জন স্টাফ, ফ্লোর ভাড়া ও রোগীদের থাকা-খাওয়া খরচ মিলিয়ে প্রতি মাসে অন্তত ২ লাখ টাকা খরচ হয়। বাকি টাকা কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে কেন্দ্রের চেয়ারম্যান মনির হোসেন দাবি করেন সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভর্তুকি দিয়ে তারা এ কেন্দ্র পরিচালনা করছেন।
তবে নারকোটিক্সের পরিদর্শন দলের সদস্যরা গোপন সূত্রে জানতে পারেন, কেন্দ্রটিতে মাদক বিক্রি করা হয়। এছাড়া রোগীদের মারধর নিয়মিত ঘটনা। কেন্দ্রের কর্মচারী রিপন, আমির, সিরাজ, সাইফুল, ফয়সাল এবং মনির চেয়ারম্যান নিজে রোগীদের ওপর নির্যাতন চালান। অনেক রোগীর পরিবারকে রাত-বিরাতে ফোন করে বলা হয় আপনার রোগীর অবস্থা খারাপ বিকাশে টাকা পাঠান। চিকিৎসা করতে হবে।
কেন্দ্রের মালিক তিনজন। একজনের নাম টুটুল মিজি, ফয়সাল হোসেন ও মনির হোসেন। এরা সবাই কোটিপতি। সবাই দামি গাড়িতে চড়েন, মিরপুরে একেকজন ২-৩টি করে ফ্ল্যাটও কিনেছেন।
রাজধানীতে এমন নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা ১০৫টি। সারা দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত নিরাময় কেন্দ্র ৩৫২টি। এগুলো বৈধ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এরপর বাইরে লাইসেন্সবিহীন ভাবে চলছে প্রায় দেড় হাজার। যেগুলোতে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হলেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেউ।
সান নিউজ/এসএ