নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনা দুর্যোগ পরিস্থিতির মধ্যেও থেমে নেই রাজধানীতে ফুটপাতের চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। করোনার প্রথম ঢেউয়ে লকডাউন শুরু হলে ব্যবসা বন্ধ করে সপরিবারে ঢাকা ছাড়েন ফুটপাতে ব্যবসা করা হকাররা। সরকার লকডাউন তুলে নিলে গ্রাম থেকে আবার ঢাকায় চলে আসেন তাদের অনেকেই।
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনভুক্ত বিভিন্ন এলাকার রাস্তা ও ফুটপাতে এখন ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন লক্ষাধিক হকার। দরিদ্র এসব মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে একশ্রেণির চাঁদাবাজ বিভিন্ন সংগঠন ও ইউনিয়নের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে রাজধানীর ফুটপাত থেকে প্রতিদিন ২ কোটি টাকার বেশী হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির দায়ে রাজধানীর ৭টি অনিবন্ধিত সংগঠন ও ইউনিয়নকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন আদালত। এগুলোর কার্যক্রম বন্ধ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনিবন্ধিত এসব সংগঠন ও ইউনিয়নগুলো হলো- বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়ন (আহ্বায়ক আবুল হাসেম কবির); ছিন্নমূল হকার্স সমিতি (সভাপতি কামাল ছিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক এমরান হোসেন); হকার্স সংগ্রাম পরিষদ (আহ্বায়ক আবুল হোসাইন); আওয়ামী হকার্স লীগ (সভাপতি জাকারিয়া হানিফ, সাধারণ সম্পাদক জাহিদ আলী); ইসলামী হকার্স শ্রমিক আন্দোলন (আহ্বায়ক আবুল কালাম জুয়েল ও যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল মান্নান); আওয়ামী হকার্স লীগ (আহ্বায়ক লিয়াকত হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক মোয়াজ্জেম হোসেন), হকার্স সমন্বয় পরিষদ (আহ্বায়ক আবুল হোসাইন)।
এ সংক্রান্ত মামলায় ঢাকা বিভাগের ৪নং রাজউক এভিনিউয়ের যুগ্ম শ্রম পরিচালককেও আসামি করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে (জেলা ও দায়রা জজ) বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এমএ কাশেম ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর জমাদার (ঠিকানা : পল্টনের ২৫ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) কর্তৃক এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ অক্টোবর ওই আদেশ দেন ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল ইমাম। বাদী আদালতের রায়ের নকল কপি হাতে পান গত ৪ নভেম্বর।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৭২ জনকে আসামি করে রাজধানীর ৩ থানায় তিনটি মামলা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সহকারী সম্পত্তি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সামসুল আলম। মতিঝিল থানায় ১৬ জন, পল্টন থানায় ৪৯ জন এবং শাহবাগ থানায় ৭ জনকে আসামি করে এ তিন মামলা হয়।
জানা গেছে, সম্প্রতি পল্টনের যে ৭টি সংগঠন ও ইউনিয়নকে অবৈধ ঘোষণা করে এগুলোর কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত, সেগুলোর বেশির ভাগ নেতাকর্মীই এই ৩ মামলায় আসামি। বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি আদালতে করা মামলায় উল্লেখ করেন- বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ১৯২ ধারার বিধানমতে রেজিস্ট্রিকরণ ব্যতীত কোনো ট্রেড ইউনিয়নের কাজ চালানো বেআইনি।
কিন্তু আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত ওই ৭ সংগঠন ও ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন না থাকা সত্ত্বেও ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অনিবন্ধিত ইউনিয়ন নামধারী এসব সংগঠন ফুটপাতে চাঁদাবাজি করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতাকর্মীরা নিজেদের হকার নাম দিয়ে যেন চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মিছিল মিটিং করতে না পারে এবং তাদের অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে- সে লক্ষ্যে আদালতের দ্বারস্থ হন হকার সংগঠনের ওই নেতা।
মামলার বাদী বাংলাদেশ হকার্স লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এমএ কাশেম শুক্রবার ( ৬ নভেম্বর) বলেন, করোনার আগে রাজধানীর দুই সিটিতে দেড় লাখেরও বেশি হকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। সরকারি নিবন্ধন ছাড়াই কয়েকটি সংগঠন রাজধানীর থানা, ওয়ার্ডে কমিটি দিয়ে সেই কমিটির নেতাকর্মীদের দিয়ে এসব হকারকে জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে দৈনিক ১০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা আদায় করে আসছিল।
এ চাঁদাবাজির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছিল নিবন্ধিত বৈধ হকার সংগঠনগুলোর ওপর। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হলেও কাজ হয়নি। ফলে আদালতে যান তিনি। ডিএসসিসির সহকারী সম্পত্তি কর্মকর্তা সামসুল আলম তার মামলাগুলোয় উল্লেখ করেন, রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে দোকান বসিয়ে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত জনচলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন হকাররা। এসব সাধারন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আসামিরা প্রতিদিন ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করেন।
ডিএসসিসির পক্ষ থেকে এসব চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এখনো এ চাঁদাবাজচক্র ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়- ঢাকায় যানজট সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ ফুটপাত দখল করে হকারদের মার্কেট করা। ঢাকায় সাধারণ রাস্তা যেখানে ২০০ কিলোমিটার সেখানে সরু রাস্তা ২ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার। দুই লেনের ২ হাজার ২১৫ কিলোমিটার রাস্তায় মাত্র ৪৩০ কিলোমিটার হাঁটা-চলার রাস্তা রয়েছে। এরও ৮৩.১ শতাংশ দখল হয়ে আছে।
সান নিউজ/এসএ