নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঝালকাঠি: শহরের সুগন্ধা পৌর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ভেঙে খেলার মাঠে অবৈধভাবে নির্মাণাধীন সেই বাণিজ্যিক মার্কেট ভেঙে ফেলা শুরু করেছে ঝালকাঠি পৌরসভা।
পৌর মেয়র লিয়াকত আলী তালুকদারের নির্দেশে বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টা থেকে ভাঙচুরের কাজ শুরু করেন শ্রমিকরা। এর আগে জোর করে পাস করানো অবৈধ মার্কেট নির্মাণের প্ল্যান বাতিল করে দেন মেয়র।
মার্কেটের দোকানের কলাম, পিলার ও গাঁথুনি ভেঙে ফেলার সময় উপস্থিত ছিলেন বিদ্যালয়ের নতুন অ্যাডহক কমিটির সভাপতি গাজী সানাউল হক, প্রধান শিক্ষক রিতা মণ্ডলসহ শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
গত ১৪ আগস্ট ম্যানেজিং কমিটির সদ্য বিদায়ী সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শারমীন মৌসুমি কেকা বিদ্যালয়ের পাঁচ হাজার ৫০০ বর্গফুটের খেলার মাঠের প্রায় দুই হাজার বর্গফুটই জায়গা নিয়ে নয়টি দোকানের ওই মার্কেট নির্মাণ শুরু করেন। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ নির্মাণকাজ সম্পন্নও হয়েছিল।
অভিযোগ রয়েছে, দোকানগুলো সরকার ও বিরোধী দলীয় কয়েকজন নেতা ও দুজন কাউন্সিলরের মধ্যে ভাগাভাগির চুক্তি হয়। ভুল বুঝিয়ে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে পৌরসভা থেকে তাৎক্ষণিক প্ল্যান নিয়ে নির্মাণ শুরু হয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই প্রায় এক তৃতীয়াংশ কাজ শেষ করা হয়েছিল।
বিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ভেঙে ফেলায় অনুভূতিতে আঘাত লাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর। বিদ্যালয়ের মাঠ সংকুচিত করে মার্কেট হলে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ব্যহত হওয়ার আশঙ্কায় অভিভাবকরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিলেন।
শহরের সার্কিট হাউস সংলগ্ন প্রধান সড়কের পাশে গুরুধাম এলাকায় ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিতে ৪৭৫ জন ছাত্রী পড়ালেখা করে। পাশের মিলন মন্দির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ৩৪০ জন ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করে। দুটি বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসপূর্ব সমাবেশ (অ্যাসেম্বলি), বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস ও ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডের জন্য একমাত্র এই খেলার মাঠটিই ছিল ভরসা। মাঠের পশ্চিম প্রান্তে ছিল শহীদ মিনার। সেটি ভেঙে ফেলার পর মার্কেটটি নির্মিত হলে ৬০ ফুট মাঠের অবশিষ্ট থাকতো মাত্র ৪৫ ফুট।
বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক গীতা রানী বলেন, ‘শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়েছিল ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। কিন্তু এটা ভেঙে ফেলে আমাদের অনুভূতিতে আঘাত হানা হয়েছে। কথা ছিল, শহীদ মিনারটি পুনর্নির্মাণের পর মার্কেট নির্মিত হবে, কিন্তু তা হয়নি।’
প্রধান শিক্ষক রিতা মণ্ডল অভিযোগ করে বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি থাকাকালে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শারমিন মৌসুমি কেকা জোরপূর্বক রেজুলেশন করিয়ে খেলার মাঠে অবৈধভাবে মার্কেটটির নির্মাণ শুরু করেছিলেন।
তিনি জানান, বিদ্যালয়ের নতুন অ্যাডহক কমিটি জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও পৌরসভার কাছে লিখিতভাবে মার্কেট ভেঙে ফেলার দাবি জানায়। পরে পৌর কর্তৃপক্ষ প্ল্যান বাতিল করে নির্মাণাধীন দোকান ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে অন্য শিক্ষকদের অভিযোগ, আটটি দোকান কমিটির সভাপতি, প্রধান শিক্ষক, সরকার দলীয় কয়েকজন নেতা ও দুজন কাউন্সিলরের মধ্যে ভাগাভাগির চুক্তি হয়। এর মধ্যে ঝালকাঠি পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান তাপুর নামেও একটি দোকান বরাদ্দ করা হয়। মার্কেট নির্মাণের পুরো কাজ ওই বিএনপি নেতাকে দিয়ে করাতে জোরপূর্বক রেজুলেশন করেন ম্যানেজিং কমিটির সদ্য বিদায়ী সভাপতি শারমীন মৌসুমি কেকা। অবৈধভাবে জোর করে দোকানগুলো নির্মাণ কাজ শুরু হলেও প্রধান শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সম্মতি ছিল।
অভিযোগ অস্বীকার করে শারমিন মৌসুমী কেকাও একই ধরনের দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সিদ্ধান্ত অনুসারে দোকান তৈরি হচ্ছিল। প্রধান শিক্ষক যদি রাজি না থাকেন, তাহলে কোনোভাবেই কাজ শুরু করা যেতো না। এখন অ্যাডহক কমিটি নির্মাণাধীন দোকান ভেঙে ফেলতে পারে না, এটি অ্যাডহক কমিটির কাজ না। পৌরসভা আমাদের প্ল্যানের অনুমোদন দিয়েছে, তারাই আবার প্ল্যান বাতিল করেছে। মেয়র তাহলে প্ল্যানে স্বাক্ষর দিলেন কেন? আমরা স্কুলের বাচ্চাদের সুবির্ধার্থে এবং তাদের পড়ালেখার খরচ কমাতে জন্য মার্কেট নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং (অ্যাডহক) কমিটির সভাপতি গাজী সানাউল হক বলেন, ‘সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূতভাবে জোর করে মার্কেট নির্মাণের রেজুলেশন করেন সাবেক সভাপতি। এটি অনৈতিক বলেই আমরা নতুন করে খেলার মাঠ ঠিক রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খেলার মাঠ নষ্ট করে কোনো স্থাপনা স্কুলে করতে দেওয়া হবে না। কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত অনুসারে খেলার মাঠ প্রয়োজন। মাঠে কোনো বাণিজ্যিক ভবন হতে পারে না।’
ঝালকাঠি পৌরসভার মেয়র লিয়াকত তালুকদার বলেন, ‘তিনি (শারমিন মৌসুমি কেকা) তখন ক্যাডার নিয়ে এসে এক টেবিলে বসেই প্ল্যান পাস করিয়ে নিয়ে গেছেন। তখন তাদের কাছে ম্যানেজিং কমিটির রেজ্যুলেশন চাইলে পরে দেবেন বলে জানায়। এ কথার ভিত্তিতেই প্ল্যান পাস করে দেই।’
‘পরে সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারি যে, শহীদ মিনার ভেঙে বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মার্কেট তৈরি করছেন তারা। ম্যানেজিং কমিটির কাছে তাদের রেজুলেশন চেয়ে তিনদিনের সময় দিয়ে চিঠি দেই। তিনদিন পার হওয়ার পর অনুমতি ও প্ল্যান বাতিল করে দেই। সময় শেষ হওয়ার পরে দোকান ভেঙে দেই। মার্কেট অপসারণে বিদ্যালয়ের বর্তমান ম্যানেজিং কমিটিও রেজ্যুলেশন করে নির্মাণাধীন দোকান ভেঙে দিতে আবেদন জানায়।’
সান নিউজ/ এআর