নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঝালকাঠি: সদ্যজাত বড় ভাইয়ের কন্যা সন্তানকে দেখতে ঢাকার উত্তরার একটি হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন তারেক হোসেন কাউয়ুম (২৭)। এদিকে মাত্র ২১ দিন আগে ঝালকাঠির বাড়িতে জন্ম নেওয়া নিজের কন্যা সন্তানকে তখনো দেখা হয়নি। ভেবেছিলেন, ভাই-ভাবির সঙ্গে ফিরে একবারে আনন্দে শামিল হবেন পরিবারে দুই নতুন মুখের আগমনে। কিন্তু একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তারেকের প্রাণ, সেই সঙ্গে স্বপ্নও।
শুধু তিনিই নন, বুধবারের (০৯ সেপ্টেম্বর) ওই দুর্ঘটনায় তারেকের সঙ্গেই মারা যান বড় ভাই আরিফ হোসেন (৩৫), মা কোহিনুর বেগম (৬৫), বোন ঢাকা সিএমএইচএসে কর্মরত আর্মড ফোর্সেস নার্সেস সার্ভিসের মেজর সুরাইয়া আক্তার শিউলী (৩০) ও ভাইয়ের শ্যালক নজরুল ইসলামও (২৮)। মর্মান্তিক ঘটনা আরো আছে। বড় ভাইয়ের যে নবজাতক মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলেন তারেক, সেই তিনদিনের শিশু তামান্না মারা যায় মঙ্গলবার (০৮ সেপ্টেম্বর) মারা যায় সেই নবজাতক। ভাইয়ের মেয়েটির মরদেহ নিয়ে পরিবারের ওই পাঁচজন অ্যাম্বুলেন্সে রওনা হয়োছলেন ঝালকাঠির বাউকাঠিতে বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বরিশালের উজিরপুর উপজেলার আটিপাড়া এলাকায় ঘটা দুর্ঘটনায় তাদের সঙ্গে নিহত হন অ্যাম্বুলেন্সচালক কুমিল্লার মো. আলমগীর হোসেনও (৪৫)।
ফলে ভাতিজির মৃত্যুশোক বুকে চেপেও নিজের ২১ দিন আগে জন্ম নেওয়া সন্তানের মুখ প্রথমবারের মতো দেখার অপেক্ষা আর শেষ হলো না তারেকের।
বুধবার বিকেলে বাস-অ্যাম্বুলেন্স-কাভার্ডভ্যানের ত্রিমুখী সংঘর্ষে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। দুই ভাই আরিফ-তারেকসহ এক পরিবারের পাঁচজনের করুণ এ মৃত্যুতে শোকের মাতম চলছে নিহতদের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি সদর উপজেলার বাউকাঠিতে।
বাউকাঠি গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে আরিফ ও তারেক ঢাকা উইনডে ওয়াশিং কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তাদের বোন মেজর শিউলী ঢাকা সিএমএইচের নার্স ছিলেন। তারা এবং আরিফের স্ত্রীর বড় ভাই নিহত নজরুলও ঢাকাতেই থাকতেন।
নিহত তারেকের ফুফাতো ভাই রাশেদুল হাসান সুমন জানান, বিয়ের সাত বছর পরে আরিফের স্ত্রী তিন্নি আক্তার (২৭) চারদিন আগে ঢাকার উত্তরার একটি হাসপাতালে কন্যাসন্তান জন্ম দেন। তারা মেয়েটির নাম রাখেন তামান্না। মঙ্গলবার শিশুটি ওই হাসপাতালেই মারা যায়। সন্তান প্রসবের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিন্নি। নাতনির মরদেহ আনতে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় যান আরিফের মা কোহিনুর বেগম। আরিফের স্ত্রী তিন্নি বেগমকে ঢাকার হাসপাতালে রেখে মৃত নবজাতক তামান্নার মরদেহ নিয়ে দাফন করতে গ্রামের বাড়িতে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মারা যায় পুরো পরিবারটি।
স্বজনেরা জানান, সন্তান জন্মের পাঁচদিন আগে তারেক ঢাকা যান চাকরিতে যোগ দিতে। সন্তান জন্মের পর সরাসরি তার মুখ দেখা হয়নি। মোবাইলে ছবি দেখেই খুশি ছিলেন। প্রিয় সন্তানকে ছুঁয়েও দেখা হলো না তার। স্বামী-ভাসুরসহ পরিবারের পাঁচজনকে দুর্ঘটনায় এবং তিনদিনের নবজাতক ভাতিঝিকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ তারেকের স্ত্রী ঝিলিমিল আক্তার মরিয়ম (২৫)। কোলে ২১ দিন বয়সের সন্তান উম্মে ফাতিমাকে নিয়ে দাফনের আগ পর্যন্ত মরদেহগুলোর পাশে আহাজারি করেছেন । কান্না যেন থামছিলই না তার। সন্তানের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল অঝোরে।
এদিকে দুর্ঘটনার খবর শুনে বুধবার সন্ধ্যার পর থেকেই নিহতদের বাড়িতে ভিড় করে স্থানীয়রা। বিভিন্ন স্থান থেকে আত্মীয় স্বজনরাও আসে নিহতের পরিবারের লোকজনকে শান্তনা দিতে। তাদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) ভোর চারটায় অ্যাম্বুলেন্সযোগে মরদেহগুলো বাউকাঠি গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হলে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। স্বজনহারাদের আহাজারি দেখে প্রতিবেশীরাও চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি। এমন মর্মান্তিক মৃত্যুকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না প্রতিবেশীরাও। নিহতের স্বজনদের শান্তনা দিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারাও। তাদের নানা স্মৃতি নিয়েও করেছেন আলোচনা।
নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় সকাল থেকে বাড়ির পাশের একটি এতিমখানায় চলে কোরআন খতম।
বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় বাড়ির পাশের মাদ্রাসা মাঠে নিহতদের মধ্যে চারজন ও নবজাতক তামান্নাসহ পাঁচজনের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। পরে পারিবারিক কবর স্থানে তাদের মরদেহ দাফন করা হয়।
নিহতদের মধ্যে শিউলী বেগমের মরদেহ স্বজনদের দেখিয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে গার্ড অব অনার দিয়ে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ফের গ্রামের বাড়িতে এনে মরদেহ দাফন করা হবে।
সান নিউজ/ এআর