নিজস্ব প্রতিবেদক:
বরিশাল ও ঝালকাঠি: নবজাতক মেয়েশিশুর মরদেহ দাফন করতে ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ঝালকাঠি সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের বাউকাঠির বাড়িতে ফেরার পথে আরও ছয়জন নিহত হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন একই পরিবারের পাঁচজন এবং অ্যাম্বুলেন্সটির চালক। মারা যাওয়া শিশুটির বাবা, চাচা, ফুফু, মামা ও দাদী। একই পরিবারের পাঁচজনকে হারিয়ে ওই বাড়িতে শোকের মাতম চলছে।
নিহতরা হচ্ছেন, বাউকাঠি গ্রামের সেরাজুল রাড়ির ছেলে আরিফ হোসেন রাড়ি (৩৫) ও তারেক হোসেন কাউয়ূম রাড়ি (২৭), আরিফের বোন শিউলী বেগম (৩০), মা কোহিনুর বেগম (৬৫) ও সম্মন্ধি নজরুল ইসলাম (৪০) এবং অ্যাম্বুলেন্সচালক কুমিল্লার মো. আলমগীর হোসেন (৪৫)।
বুধবার (০৯ সেপ্টেম্বর) বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার আটিপাড়া এলাকায় বাস, কাভার্ডভ্যান ও অ্যাম্বুলেন্সের ত্রিমুখী সংঘর্ষে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত আরিফের ফুফাতো ভাই রাশদেুল হাসান সুমনের বরাত দিয়ে উজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল আহসান জানান, আরিফের স্ত্রী তিন্নি বেগম চারদিন আগে ঢাকার উত্তরার একটি হাসপাতালে কন্যাসন্তানটির জন্ম দেন। তারা মেয়েটির নাম রাখেন তামান্না। মঙ্গলবার (০৮ সেপ্টেম্বর) শিশুটি ওই হাসপাতালেই মারা যায়। আরিফের স্ত্রী তিন্নি বেগমকে ঢাকার বাসায় রেখে মৃত নবজাতক তামান্নার মরদেহ নিয়ে দাফন করতে গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির বাউকাঠিতে ফিরছিলেন পুরো পরিবারটি। পথিমধ্যে এই বিয়োগান্তক ঘটনাটি ঘটলো।
নিহতদের পরিবারের লোকজন জানান, আরিফ ঢাকায় চাকরি করেন। বিয়ের সাত বছর পরে তাদের কন্যা সন্তান তামান্না জন্ম নেয়। অসুস্থ অবস্থায় নবজাতক মেয়েটি মারা গেলে মরদেহ আনতে ঝালকাঠি থেকে ঢাকা যান আরিফের মা কোহিনুর বেগম ও বোন শিউলী বেগম। অন্যরা ঢাকাতেই থাকতেন।
অ্যাম্বুলেন্সচালক আলমগীর হোসেন কুমিল্লা সদর উপজেলার মৃত ইদ্রিস আলী মিয়ার ছেলে। তিনি স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঢাকার উত্তরায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। আলমগীর হোসেনের বোন পাখি আক্তার জানান, তার ভাই বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতাল থেকে শিশুটি মরদেহ নিয়ে ঝালকাঠির বাউকাঠি গ্রামে যাচ্ছিলেন। ভাইয়ের সঙ্গে তার সর্বশেষ দুপুর দুইটায় কথা হয়।
ওসি জিয়াউল আহসান জানান, অ্যাম্বুলেন্স ছাড়াও বাসের ২০ জন যাত্রী আহত হয়েছেন। মরদেহগুলো গৌরনদী হাইওয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আহতদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতাল ও বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বৃষ্টি উপেক্ষা করেই উদ্ধার অভিযান শেষ করে দুর্ঘটনায় পতিত গাড়িগুলো সড়ক থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ত্রিমুখী সংঘর্ষে দুর্ঘটনার পর ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ ছিল। বর্তমানে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।
গৌরনদী হাইওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অশোক কুমার এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঢাকার উত্তরা থেকে বরিশালগামী শিশুর মরদেহবাহী অনিক অ্যাম্বুলেন্সটির (ঢাকা মেট্রো-ছ-৭১১৭-১৩) সঙ্গে বরিশাল থেকে ছেড়ে আসা খুলনার গাজী রাইস মিলের কাভার্ডভ্যানটির (ঢাকা মেট্রো-ট ১১৬৩৬৮) মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। একই সময় পেছনে থাকা কুয়াকাটা থেকে ঢাকাগামী মায়া পরিবহনের দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসটি (খুলনা মেট্রো ব ১১-০১৭১) কাভার্ডভ্যানটিকে ধাক্কা ও অ্যাম্বুলেন্সটিকে চাপা দেয়। এতে অ্যাম্বুলেন্সটি চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে ঘটনাস্থলেই এর পাঁচজন আরোহীর মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত শিউলী বেগমকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনিও মারা যান।
তিনি জানান, দুর্ঘটনায় বাসের ২০ যাত্রী আহত ও বাসের সামনের বড় কাচ ভেঙে যায়। ঘটনার পর গৌরনদী হাইওয়ে থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।
উজিরপুর থানার ওসি জিয়াউল আহসান আরও জানান, তার থানার পুলিশ ও গৌরনদী হাইওয়ে থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় উদ্ধার তৎপরতা চালায়। নিহতদের মরদেহ ও আহত একজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর পর তিনিও মারা যান।
উদ্ধার অভিযান থেমে থেমে চালাতে হয় উল্লেখ করে জিয়াউল আহসান বলেন, বিকেল থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে উজিরপুরে। দুর্ঘটনায় অ্যাম্বুলেন্সটি দুমড়ে গেছে। গাড়ি কেটে মরদেহ উদ্ধার করতে হয়।
মূলত চালকদের বেপরোয়া গতি এবং প্রবল বৃষ্টির কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গৌরনদী হাইওয়ে থানার এসআই অশোক কুমার আরও বলেন, হাইওয়ে থানার পুলিশ অ্যাম্বুলেন্সে থাকা শিশুর মরদেহসহ ছয়টি মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে এসেছে। এছাড়া দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত শিউলি বেগমকে স্থানীয়রা বরিশালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। নিহতরাসহ সাতজনের মরদেহই ময়না তদন্তের জন্য বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হবে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। বাস ও কাভার্ডভ্যান জব্দ করা হয়েছে।
নবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের বাউকাঠি গ্রামের ইউপি সদস্য চুন্নু সিকদার বলেন, তিনদিনের বাচ্চা হাসপাতালে মারা যায়। তাকে দাফন করতে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসার পথে সড়ক দূর্ঘটনায় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা শিশু তামান্নার বাবা, চাচা, ফুফু, দাদী ও মামা মারা যান। এ খবর এলাকায় পৌঁছালে শোকের মাতম চলছে।