নিজস্ব প্রতিবেদক:
খুলনা: কারাগারের কনডেম সেলে ২০ বছর থাকার পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে মুক্তি পেয়েছেন স্ত্রী ও শিশুসন্তান হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত শেখ জাহিদ (৫০)।
স্ত্রী রহিমা ও দেড় বছরের মেয়ে রেশমা হত্যার ঘটনার প্রায় দুই যুগ পরে আর জাহিদ কারাগারে যাওয়ার ২২ বছর পরে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাকে ওই হত্যার দায় থেকে মুক্তি ও বেকসুর খালাস দিয়েছেন গত ২৫ আগস্ট।
সোমবার (৩১ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিটে শেখ জাহিদ খুলনা জেলা কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। এ সময় তার স্বজনরা তাকে পেয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। মুক্তির পর তাকে খুলনা মহানগরীর মিয়াপাড়া এলাকায় তার বোনের বাসায় নেওয়া হয়।
জাহিদ শেখ বলেন, ‘বিনা অপরাধে কারাগারে থেকে জীবনের মূল্যবান ২২টি বছর নষ্ট হয়ে গেলেও এর জন্য কাউকে দায়ি বা কারো শাস্তি চাই না। কারাগারের প্রতিটি মূহুর্ত মৃত্যুর প্রহর গুণেছি। আমি ভাবতেও পারিনি, মুক্তি পাবো। আমি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। বাকি জীবন আল্লাহ’র ইবাদত-বন্দেগি করেই পার করবো।’
এর আগে দুপুরে শেখ জাহিদের খালাসের রায়ের কাগজপত্র বাগেরহাট আদালত থেকে খুলনা জেলা কারাগারে এসে পৌঁছালে তার মুক্তির কার্যক্রম শুরু হয়।
খুলনা জেলা কারাগারের সুপার মো. ওমর ফারুক বলেন, আদালতের নির্দেশনা হাতে পাওয়ার পরই সন্ধ্যায় শেখ জাহিদকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
১৯৯৪ সালে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার উত্তরপাড়ার ময়েন উদ্দিনের মেয়ে রহিমার সঙ্গে খুলনার রূপসা উপজেলার নারিকেলি চাঁদপুরের ইলিয়াছ শেখের ছেলে জাহিদ শেখের বিয়ে হয়। জাহিদ শেখ প্রথমে শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থাকতেন। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের তিনমাস আগে থেকে রহিমার বাবার বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে পাকা ঘরে বসবাস শুরু করেন ওই দম্পতি। ওই ঘরে মা রহিমার সঙ্গে খুনের সময় তাদের মেয়ে রেশমা খাতুনের বয়স ছিল দেড় বছর।
জেল সুপার মো. ওমর ফারুক জানান, স্ত্রী ও দেড় বছরের শিশু সন্তান হত্যাকাণ্ডের দায়ে ২০০০ সালের ২৫ জুন মৃত্যুদণ্ড হয় জাহিদ শেখের। তারপর থেকেই তিনি কারাগারের কনডেম সেলে টানা ২০ বছর ধরে মৃত্যুর প্রহর গুণছিলেন। তারও দুই বছর আগে ১৯৯৮ সাল থেকে কারাগারে ছিলেন তিনি। ২৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ শেখ জাহিদকে খালাসের রায় দেন।
দীর্ঘ ২২ বছর পর শেখ জাহিদের মুক্তির খবরে তার স্বজনেরা আগে থেকেই জেলা কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তার চাচা শেখ আশরাফুজ্জামান, ভগ্নিপতি আজিজুর রহমান ও আব্দুস সালাম এবং তার ছোট বোন।
শেখ জাহিদ সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘ফাঁসির কনডেম সেলে প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যু কামনা করতাম।’
মুক্তির জন্য তিনি মহান আল্লাহ’র কাছে শুকরিয়া আদায় এবং কারা কর্তৃপক্ষ, যারা তার মুক্তির জন্য সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
জাহিদের ভগ্নিপতি আজিজুর রহমানের দাবি, প্রথমে জাহিদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আইনে ফকিরহাট থানায় মামলা হলে মামলার তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা জাহিদের পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ দাবি করেন। সেই টাকা দিতে না পারায় জাহিদকে স্ত্রী-মেয়ে হত্যা মামলায় একতরফা দোষী সাব্যস্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়। ২২টি বছর নষ্ট হওয়ায় জাহিদ যেন বাকি জীবন কিছু করে খেতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।
১৯৯৭ সালের ১৬ জানুয়ারি বিকালে রহিমার মা আনজিরা বেগম মেয়ের বাড়ির দরজা ভেজানো অবস্থায় দেখতে পান। বাইরে থেকে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর কাঁথা ও লেপের নিচে বাচ্চাসহ রহিমার মরদেহ পান তিনি। ওই ঘটনায় রহিমার বাবা ময়েন উদ্দিন পরদিন ফকিরহাট থানায় হত্যা মামলাটি করেন। ১৯৯৮ সালের ১৯ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তার আগেই ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান জাহিদ।
হত্যাকাণ্ডের তিন বছরের মাথায় ২০০০ সালের ২৫ জুন বাগেরহাটের জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসামি শেখ জাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর জেল আপিল করেন তিনি। সে হিসাবে আসামি জাহিদ শেখ ২০ বছর ধরে কনডেম সেলে ছিলেন। ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) ও জেল আপিলের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৩১ জুলাই ফাঁসির রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে জেল আপিল করেন আসামি জাহিদ শেখ। গত ২৫ আগস্ট সে আপিলের শুনানি শেষে রায় দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
সান নিউজ/ এআর