সান নিউজ ডেস্ক:
ক্রমেই হুমকিতে পরিণত হচ্ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষেরা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্ব হওয়ায় কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়েছে। গত তিন বছরে শুধুমাত্র কক্সবাজার শহর ও আশপাশের এলাকাগুলোতে বসতি গড়েছে অন্তত অর্ধলাখ রোহিঙ্গা। এর আগেও মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশের পর স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।
এসব রোহিঙ্গা প্রথমে ভাড়া বাসায় উঠে রিকশা, ইজিবাইক ও বিভিন্ন চাষাবাদে শ্রমিক হিসেবে অবস্থান নেয়। পরে ধীরে ধীরে বসতি শুরু করে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের এসব মানুষ। কৌশলে জাতীয় পরিচয় পত্র সংগ্রহ করে মিশে যাচ্ছে জনস্রোতে।
কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, নাজিরারটেক, ঘোনারপাড়া, বইল্যাপাড়া, ফাতেরঘোনা, বৈদ্যঘোনা, খাজামঞ্জিল, লাইট হাউসপাড়া, পেশকারপাড়া, হাজিপাড়া, সিকদারপাড়া, পাহাড়তলী, ইসলামপুর, হালিমাপাড়া, জিয়ানগর ও লিংকরোড সহ শহরের আশপাশের এলাকায় অধিকাংশ রোহিঙ্গা বসতি স্থাপন করছে। এসব রোহিঙ্গার একাংশ দিনমজুর, জেলে শ্রমিক, রিকশা, ইজিবাইক শ্রমিক ও স্থানীয় বাংলাদেশিদের বাড়ি চাষাবাদের কাজ করলেও অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে অপরাধ জগতে। শহরে চুরি, ছিনতাই ও ইয়াবা পাচারসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। আবার অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে কৌশলে বাগিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশি ভোটার আইডি। ভোটার তালিকায় নাম লিখিয়ে নানাভাবে এখন প্রভাব বিস্তার করছে।
‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ সংগঠনের সমন্বয়ক মো. কলিম উল্লাহ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘যেভাবে রোহিঙ্গারা কক্সবাজার শহরে অবস্থান নিয়েছে, হয়তো কয়েক বছর পরে এটি রোহিঙ্গা শহরে পরিণত হবে। রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য স্থানীয়রা প্রথমে নানা সুযোগ সুবিধা দেয়। ঘর ভাড়া থেকে শুরু করে দোকানের কর্মচারী, মজুর, রিকশা, ইজিবাইক চালানোর সুযোগ করে দেয়। আমরা অনেকেই রোহিঙ্গাদের জমি বিক্রি এবং বিয়ে-শাদি করে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছি। এ কারণে কক্সবাজার শহরে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। বেড়েছে পর্যটক হয়রানি। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পর্যটকরা কক্সবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে’।
কলিম উল্লাহ আরও বলেন, ‘কক্সবাজার শহর এবং শহরের বাইরে কতজন রোহিঙ্গা বসবাস করছে এর কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে তিন বছর আগে অর্ধলাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার শহরে অবস্থান নিয়েছে। এর আগে থেকে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। কক্সবাজার শহরে এসব রোহিঙ্গার বেশিরভাগ রিকশা ও ইজিবাইক চালক। এদের কাছে প্রতিনিয়ত শুধু পর্যটক নয়, স্থানীয়রা নাজেহাল হচ্ছে।’
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটিজ ফোরামের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে কক্সবাজার শহরে অর্ধ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছে। জেলে, শ্রমিক, দোকান শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, রিকশা ও ইজিবাইক থেকে শুরু করে সব ধরনের শ্রমবাজার রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। মজুরি কম নেওয়ায় স্থানীয়রা রোহিঙ্গা শ্রমিকদের কাজ করাচ্ছে বেশি। বিশেষ করে কক্সবাজার শহরে রোহিঙ্গাদের বিচরণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।'
কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ রোড হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোখিম খান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পর্যটন এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরা রয়েছে। সৈকতে ভাসমান ব্যবসা থেকে শুরু করে সবকিছু রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যাচ্ছে। তাদের খারাপ ব্যবহার, অশালীন আচরণ, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে রিকশা ভাড়া বেশি আদায়সহ নানা কারণে পর্যটকরা বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই বিচরণ বন্ধে সঠিক পদক্ষেপ নিতে কেউ এগিয়ে আসছে না।'
এ বিষয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়োজিত ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) পুলিশ সুপার হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সবেমাত্র কাজ শুরু করেছি। প্রায় দুই মাস পার হতে চলেছে এপিবিএন সদস্যরা কাজ করছে। শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্প নয়, ক্যাম্পের বাইরেও আমাদের তিনটি চেকপোস্ট রয়েছে। এসব চেকপোস্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা যাতে পারাপার করতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক আছি।'
হেমায়েতুল ইসলাম আরও বলেন, ‘২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা আগমনের তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে। প্রতি বছর এ সময়ে রোহিঙ্গারা সভা-সমাবেশ করতে চায়। এই বছরে আর যাতে কোনও ধরনের সভা-সমাবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রতিটি ক্যাম্পে অবস্থানরত প্রধান রোহিঙ্গা নেতাদের নিষেধ করা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সে দেশের সেনাবাহিনী নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। তারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ১০ হাজার একর বনভূমির ওপর অস্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। দীর্ঘ তিন বছর ধরে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গাকে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার পাশাপাশি কাজ করছে দেশের বিভিন্ন এনজিও।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন