মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ: জন্মের পর হতেই শুনতেছি, আমরা খেয়াপার হইতেছি। এমপি মন্ত্রী আসতেছে, চেয়ারম্যান আসতেছে ব্রীজ কইরা দিব। এভাবেই ৪০ বছর কাটতাছে এ রকম কথা শুনতে শুনতে বুড়া হয়ে গেলাম। কিন্তু ব্রীজ হইল না! আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিল সুফিয়ান মোল্লা (৭০)।
আরও পড়ুন: ফতুল্লায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ ৩
তিনি বলেন, নির্বাচন আসলে নদী মাপা শুরু হয়। দুই তিন লাখ টাকা খরচ করে নদী মাপে। নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে আর কারো, খোঁজ পাওয়া যায় না। কেউ আসে না।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার চরাঞ্চল আধারা ইউনিয়নের ৩০ হাজার মানুষের সারা বছরই খেয়া দিয়ে পার হয়ে আসতে হয়, মূল ভূখণ্ডে। রজতরেখা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন এই সমস্ত মানুষদের পারাপারে ১২ মাসই খেয়াই একমাত্র ভরসা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদর উপজেলার কালিরচর, সৈয়দপুর, বকচর, চর আব্দুল্লাহ গ্রামের মানুষের বাড়ি হতে বের হয়ে, মূল ভূখণ্ডের সাথে যোগাযোগের একমাত্র বাহন হল খেয়া। প্রথমে তাদের বাড়ি হতে বের হয়ে রজতরেখা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন এই সমস্ত মানুষকে খেয়া দিয়ে আসতে হয় চিতলীয়া বাজার।
আরও পড়ুন: শেষ হচ্ছে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা
বাজারে আসার পরে মূল ভূখণ্ডের সাথে যোগাযোগ করতে পারে তারা। চিতুলীয়া বাজারের পাশে রজতেরেখা নদীতে গড়ে উঠেছে খেয়াঘাট। অর্ধশতাধিক ট্রলার ও নৌকায় দিয়ে হতে নিয়মিত যাতায়াত করে, যাত্রীদের নিয়ে।
নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন সৈয়দপুর, বকচর, চর আব্দুল্লাহ গ্রামে রয়েছে খেয়াঘাট। গ্রামগুলোর খেয়াঘাট হতে ট্রলারে নৌকায় করে চিতলীয়া ঘাট হয়ে যাতায়াত করতে হয় ঐ গ্রামের মানুষদের।
বকচর হতে ১৫ টাকা, চর আব্দুল্লাহপুর, সৈয়দপুর হতে ১০ টাকা ভাড়ায় প্রতিদিন যাতায়াত করে যাত্রীরা। বর্ষ আসলে নদীটি ৫০০ মিটারের অধিক আকার ধারণ করে তবে শীত মৌসুমে আবার নদীটি শুকিয়ে অনেকটা ছোট হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: আমরা বিদেশিদের বন্ধু মনে করি প্রভু নয়
সৈয়দপুর গ্রামের জয়নাল আবেদীন পাইক (৭০) বলেন, ৪০ বছর ধরে শুনছি ব্রীজ হইবো। কিন্তু ব্রীজ তো হয় না। নির্বাচন আসলেই এমপিরা বলে, ব্রীজ করে দিব। তারপর আর খোঁজ থাকে না।
তিনি আরো বলেন, সৈয়দপুর গ্রামে আমাদের ভোটার সংখ্যাই ১০ হাজার সব মিলে আমাদের গ্রামের ২০ হাজার মানুষ জন্মের পর থেকে ট্রলারে পারাপার হচ্ছে। সারা বছরই ট্রলারে পার হচ্ছি। এখন বুড়া হয়ে গেছি মরনের আগে মনে হয়, আর ব্রিজ দেই খা যাইতে পারমু না।
সরকারি হরগঙ্গা কলেজের ছাত্র মো. রানা বলেন, সারা বছরে আমাদের এখানে হতে খেয়া পার হয়ে পারাপার হতে হয়। রাত দশটার পরে খেয়া নৌকা থাকে না, তখন আর গ্রাম হতে বের হতে পারি না আমরা।
আরও পড়ুন: সাপের কামড়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু
আকবর হোসেন (৬৫) বলেন, কতবার নদী মাপলো। নির্বাচন আইলেই মাপে, কথা দেয় ব্রীজ কইরা দিবো। কিন্তু নির্বাচন গেলে আর কাউকে পাওয়া যায় না। নির্বাচন এলেই স্থানে স্থানে মাপে তারপর আর খোঁজ থাকে না। আমরা যে কত কষ্টে আছি তা বলার বাহিরে।
বাংলাদেশের ভিতরে এরকম স্থান মনে হয় আর নাই। বর্ষাকালে ঠিকমতো খেয়া পার হতে পারলেও শীতকালে নদী শুকিয়ে হাঁটু পর্যন্ত পানি হয়ে যায়। তখন নদীতে খেয়া আটকে যায়। তখন আমাদের পানি দিয়ে, কাঁদা দিয়ে হেঁটে পারাপার হতে হয়।
জাজিরা গ্রামের ট্রলার চালক মজিবুর রহমান বলেন, চিতলীয়া খেয়াঘাটে ৪০ টি ট্রলার ও নৌকা আছে। আমরা প্রতিদিন এই সমস্ত নৌকা ও ট্রলার দিয়ে মানুষ পারাপার করে থাকি। বৃষ্টির দিনে আমাদের বেশ ঝামেলা হয় মানুষ পারাপার করতে। বৃষ্টি নামলে পলিথিন মুড়ি দিয়ে মানুষ পারাপার হয়।
আরও পড়ুন: পদ্মায় উঠলো ২২ কেজি কাতল
ওপর ট্রলারে চালক সৈয়দপুর গ্রামের পলাশ বলেন ১২ বছর যাবত এই ঘাটে ট্রলার চালাই। সকাল হতে রাত ৮টা পর্যন্ত আমি সাধারণত থাকি। তারপরে আর থাকিনা। ট্রলার না থাকলে মানুষ গ্রাম হতে বের হতে পারেনা।
এ ব্যাপারে আধারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসেন বলেন, এখানে অনেক বড় ব্রীজ প্রয়োজন। যা নির্মাণ করতে প্রায় ৩০০ শত কোটি টাকা প্রয়োজন। আমরা চেষ্টাও করতাছি। কিন্তু অনেক টাকার প্রয়োজন বিধায়, এখানে ব্রীজের কাজটি সেভাবে আগাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হোসাইন মো. আল- জুনায়েত বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনার মূখে প্রথম শুনলাম। তারপরেও আমি খোঁজ-খবর নিবো।
সান নিউজ/এইচএন