নিজস্ব প্রতিবেদক:
সাগরে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ও অমাবস্যার প্রভাবে কয়েক দিন ধরে সারা দেশে ঝরছে বৃষ্টি। টানা বর্ষণের কারণে উপকূলজুড়ে দেখা দিয়েছে অধিক উচ্চতার জোয়ার।
ভাদ্রের এই সময়ে এর আগে কখনো এমন উচ্চতায় জোয়ারের পানি দেখেনি উপকূলের মানুষ। এই প্রেক্ষাপটে উপকূলেও হানা দিয়েছে বন্যা।
আবহাওয়া অফিসও বলছে, এই সময়ে উপকূলে এ রকম জোয়ার আগে দেখা যায়নি। কয়েক দিনের টানা ভারি বর্ষণে উপকূলের বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চল এখন পানির নিচে। তিন মাস আগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তোড়ে সুন্দরবনসংলগ্ন জনপদের বিশাল এলাকার নদীর বাঁধ স্থানে স্থানে ভেঙে গিয়েছিল। ভাঙা বাঁধের স্থানে জোয়ারের পানি আটকাতে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে রিং (বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে আংটির মতো ঘুরিয়ে দেওয়া) বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। কয়েক দিনের টানা বর্ষণে জোয়ারের তোড়ে শনিবার (২২ আগস্ট) অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে এসব রিং বাঁধ। সাতক্ষীরার কয়রা, শ্যামনগর ও আশাশুনির একাধিক জায়গায় বাঁধের ভাঙা স্থান দিয়ে পানি ঢুকে ফের এলাকা ডুবেছে।
এলাকাবাসী আবারও রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বাগেরহাটে বলেশ্বর নদী পারের বেড়িবাঁধের বাইরের অংশে নদীর তীরবর্তী ৬ টি গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। ভোলার চরফ্যাশন ও মনপুরায় ভারি বর্ষণ ও পূর্ণিমার জোয়ারে বেশির ভাগ আউশ-আমন বীজতলা, রোপা আউশ, পানের বরজ, শাকসবজিসহ ফসলের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। একই সঙ্গে ছোট ছোট খাল-বিলের পানি উপচে ভেসে গেছে কয়েক কোটি টাকার মাছ। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি চরফ্যাশন ও মনপুরার প্রায় ২৫ হাজার চাষি। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে রাজবাড়ীতে পদ্মার পানি বিপত্সীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৭ জুন থেকে শুরু হওয়া বন্যার পানি এখনো কয়েকটি জেলা থেকে নামেনি।
আবহাওয়া অফিস এবং বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, অমাবস্যা শুরু হয় গত বুধবার। পরদিন বৃহস্পতিবার বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া সুস্পষ্ট লঘুচাপটি এখন ভারতের মধ্যপ্রদেশে অবস্থান করছে। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে আসাম পর্যন্ত এর বিস্তৃতি রয়েছে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হওয়ার কারণে খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে দেখা দিয়েছে অধিক উচ্চতার জোয়ার।
অন্যদিকে টানা বৃষ্টিতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীতে ফের পানি বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া ভারি বর্ষণের প্রভাব পড়েছে দেশের মধ্যাঞ্চলেও। মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী ও ফরিদপুরে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে আজ রোববারও সারা দেশে বৃষ্টি হবে। বিশেষ করে উপকূলীয় জেলায় বেশি বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন বলেন, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় আগস্টজুড়েই বৃষ্টি থাকবে। তবে সোম ও মঙ্গলবার বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কম থাকতে পারে। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে বাতাসের গতিবেগ থাকে আট থেকে দশ কিলোমিটার। কিন্তু সেটি এখন ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার বেগে বইছে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হলে বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প ঢুকে স্থলভাগে এসে বৃষ্টির মেঘ তৈরি করে। গতকাল সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে যশোরে, ৮৮ মিলিমিটার। এ ছাড়া কক্সবাজারে ৭০ মিলিমিটার, কুতুবদিয়ায় ৬২ মিলিমিটার।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, তাদের পর্যবেক্ষণে থাকা ১০১টি স্টেশনের মধ্যে পানি বেড়েছে ৫৬টির, কমেছে ৩১টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ছয়টি নদীর স্টেশনের পানি। এখনো বিপত্সীমার ওপরে রয়েছে আত্রাই, ধলেশ্বরী ও পদ্মা নদীর পানি। টানা ভারি বর্ষণের কারণে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সময় আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী উদয় রায়হান বলেন, কয়েক দিনের টানা বর্ষণে উপকূলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে খুলনা ও বরিশালে অধিক জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশে ভারি বর্ষণের আভাস দেওয়া হয়েছে। ফলে জোয়ারের সময় পানি উঠে আজও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
এদিকে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ ভেঙে দুই উপজেলার ২৪ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। শ্যামনগরের গাবুরা ও আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্রউলা ও সদর ইউনিয়নের বেঁড়িবাঁধের ৩২টি স্থান ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এতে শতাধিক মাছের ঘের, ঘরবাড়িসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জোয়ারের পানিতে নোয়াখালীর হাতিয়ার কয়েকটি এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এর ফলে এ দ্বীপাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। এসব দুর্গত এলাকায় গতকাল পর্যন্ত সরকারি কোনো ত্রাণ পৌঁছেনি। খাদ্য সংকটে পড়েছে গবাদি পশু। ভেসে গেছে উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের শত শত কাঁচা ঘরবাড়ি ও খামারের মাছ।
এদিকে সাগরে তৈরি হওয়া লঘুচাপ ও অতিবৃষ্টিতে খুলনায় কয়রার রিং বাঁধগুলোর একাধিক জায়গা ভেঙে গেছে। এসব ভাঙনে কয়রা সদর, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি এবং লেবুবুনিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
কয়েক দিনের বৃষ্টি ও লঘুচাপের প্রভাবে বরগুনায় বিষখালী নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৪ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে তলিয়ে গেছে দক্ষিণ গুধিকাটা গ্রাম। প্রতিদিন দুবার জোয়ারের পানি ঢুকছে প্রতিটি বাড়ির উঠানে। এখনো পানির নিচে রয়েছে ফসলি ক্ষেত ও মাছের ঘের। ছোট-বড় মিলিয়ে ৩০টি মাছের ঘের তলিয়ে যাওয়ায় হতাশ খামারিরা। কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে বেতাগীর বুড়ামজুমদার ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ভেঙে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পাঁচ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি রয়েছে।
লঘুচাপের প্রভাবে নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানি বেড়ে যাওয়ায় তিন দিন ধরে বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকছে। চিতলমারী ও কচুয়ায় আউশ ও রোপা আমন ক্ষেত প্লাবিত হয়েছে। দুই উপজেলার প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমির ফসল ডুবে গেছে।
অস্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে পিরোজপুরের ইন্দুরকানীর অনেক নতুন এলাকা। পানি বাড়ার কারণে ৩০ থেকে ৩২টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে। কচা ও বলেশ্বর নদের পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে এবং নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলো দিয়ে পানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে।
বেড়িবাঁধ উপচে জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে পটুয়াখালীর গলাচিপার অন্তত ৩০টি গ্রাম। গলাচিপার পৌর এলাকারই পাঁচটি ওয়ার্ডের বেড়িবাঁধের বাইরের বসতবাড়িসহ দোকানপাট প্লাবিত হয়েছে। এতে দুর্বিষহ অবস্থায় জীবন-যাপন করছে এ এলাকার বেড়িবাঁধের বাইরে ও প্লাবিত হওয়া এলাকার মানুষ। রাঙ্গাবালীর আট গ্রাম ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ৫০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি ঢুকে পড়েছে বসতঘর ও বিভিন্ন স্থাপনায়। শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় পানি ভেঙে যাতায়াত করছে স্থানীয় বাসিন্দারা। বসতঘরে পানি ঢুকে পড়ায় জেলার নদীতীরের বাসিন্দারা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে পানের রবজ, মাছের ঘের, ছোট-বড় অসংখ্য পুকুর ও আমনের বীজতলা। ঘের ও পুকুর থেকে ভেসে গেছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
সান নিউজ/ আরএইচ