সৈয়দ মেহেদী হাসান, বরিশাল থেকে:
উত্তাল হয়ে একদিকে ভাঙছে জনপদ। অন্যদিকে শাখা খালগুলো নাব্যতা ধরে রাখতে না পারায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সর্বনাশা সন্ধ্যা নদীর দ্বিমুখী এ আগ্রাসনে ইতোমধ্যেই শতকোটি টাকার সম্পত্তি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে আরও বিস্তীর্ণ জনপদ আর বহু মূল্যবান স্থাপনা।
আবার নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার মুখে প্রায় ভেস্তে যেতে বসেছে সরকার নির্ধারিত নদীশাসন কর্মপরিকল্পনা। ফলে নদীভাঙন আর খালগুলোর অনিয়ন্ত্রিত পানিপ্রবাহে দিন দিন বদলে যাচ্ছে বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার মানচিত্র।
পানি উন্নয়ন বোর্ড উজিরপুরে নদী ভাঙন রোধে সন্ধ্যা নদীর শাখা লস্করপুর-বড়াকোঠা খালে ‘সন্ধ্যা নদীশাসনকল্পে ড্রেজিং’ প্রকল্পের কাজ করছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন নদীশাসনের কোনো কাজই এগিয়ে নিচ্ছেন না। ড্রেজিংয়ে আসা ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যান্ত্রিক ত্রুটির অজুহাতে ইতোমধ্যে এক বছর মেয়াদী প্রকল্পের মেয়াদের ১১ মাসই পার করে ফেলেছেন। সরকারি ড্রেজার যান্ত্রিক ত্রুটিতে থেমে থাকলেও অসাধু কিছু ব্যক্তির ড্রেজার দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন চলছেই বলেও অভিযোগ করছেন উজিরপুরবাসী।
যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, বরাদ্দের টাকা না আসায় কাজ এগিয়ে নিতে পারছেন না তারা। তা আবার মানতে নারাজ স্থানীয়রা।
আবার পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দিপক রঞ্জন দাস বিষয়টি জানেনই না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়টি জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’
উপজেলার বড়াকোঠা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, তীব্র ভাঙনের পাশাপাশি সন্ধ্যা নদীর শাখা খালগুলো নাব্যতা ধরে রাখতে না পারায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে গত কয়েক বছরে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক ঘর-বাড়ি নদীতে হারিয়ে গেছে। যেখানে হাট-বাজার ছিল, তাও আজ নদীর মধ্যে। ইতোমধ্যেই নদীতে বিলীন হওয়া সম্পত্তির মূল্য শতকোটি টাকা।
তিনি জানান, বর্তমানে উপজেলার চথলবাড়ি মডেল বাজার, আব্দুল মজিদ বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবন, চথলবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালের দুইতলা ভবন, পোস্ট অফিস, নারিকেলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিনটি মসজিদ, নবনির্মিত উজিরপুর-সাতলা সড়কও রয়েছে ভাঙন ঝুঁকিতে।
এভাবে চলতে থাকলে উজিরপুর উপজেলাই নদীগর্ভে হারিয়ে যাবে বলেও আশঙ্কা করছেন ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম।
বড়াকোঠা ইউনিয়নের লস্করপুর-বড়াকোঠা খালে গত বছরের সেপ্টেম্বর ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেজিং প্রকল্পের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. শাহে আলম। এক বছরের মেয়াদে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ড্রেজিং কাজ শেষ করার কথা।
কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের দ্বায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এক তৃতীয়াংশ কাজও এখনো শেষ হয়নি। উজিরপুরে ড্রেজিং কাজ পরিচালনাকারীর বিরুদ্ধে বালু বিক্রির অভিযোগও এসেছে।
খনন কাজে নিয়োজিত ড্রেজার ডিভিশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান জানান, এক বছরে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২০০ মিটার প্রস্থের নদী ড্রেজিংয়ের নির্দেশনা ছিল। এখন পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৫০ মিটার প্রস্থের খনন কাজ শেষের পথে। মূলত যান্ত্রিক ত্রুটিতে কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
যদিও বরাদ্দ সময়মতো পাননি বলে দাবি করেছেন ড্রেজিংয়ের দ্বায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আব্দুস ছালাম ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী গোলাম নবী। তারা জানান, এক বছরে মাত্র দুই কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে। অথচ নির্ধারিত প্রকল্প শেষ করতে দরকার ১২ কোটি টাকা।
বড়াকোঠা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হারুন অর রশিদ অভিযোগ করেন, ড্রেজিং বিভাগের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে উদাসীনতায় লস্করপুর-বড়াকোঠা খালের খনন শেষ হচ্ছে না। ফলে সন্ধ্যার পানিপ্রবাহ ব্যহত হচ্ছে। চলাচলে ব্যহত হওয়া এই পানি ও নদীভাঙন দিন দিন বদলে দিচ্ছে উজিরপুরের মানচিত্র।
তার দাবি, ‘নদীভাঙনে মানুষ উন্মুল হয়ে যাচ্ছেন। সব হারিয়ে শহরে গিয়ে বস্তিতে বসবাস করছেন, সেই খেয়াল নেই ড্রেজিং বিভাগের। প্রকল্প এসেছে, ড্রেজার এনে রেখেছে। আমরা বড় বড় ড্রেজার দেখে শান্তি পাচ্ছি। কিন্তু লস্করপুর খালখননের কোনো অগ্রগতি দেখছি না।’
সান নিউজ/ এআর