কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার দাদপুর ইউনিয়নে অবস্থিত 'চিতারবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়'র এক একর পঁচিশ শতাংশ জায়গার মধ্যে এক একর জায়গাই প্রভাবশালীদের বেদখলে। বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির স্বামীসহ অন্তত ৩৮ জন অবৈধভাবে বিদ্যালয়ের সিংহভাগ জায়গাই জবরদখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
আরও পড়ুন : দুপুরে এলপিজির নতুন মূল্য ঘোষণা
এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে আবেদন করেও গত পাঁচ বছরে কোন সুরাহা হয়নি। সম্ভব হয়নি বিদ্যালয়ের জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করা।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বোয়ালমারী উপজেলার ১৪ নং চিতারবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাজিতপুর, মোবারকদিয়া মৌজার বিএস ২৩৩৮, ৬২০ খতিয়ানে নিজস্ব জমির পরিমাণ এক একর ২৫ শতাংশ। কিন্তু বিদ্যালয়ের বর্তমান দখলকৃত জমির পরিমাণ ২৫ শতাংশ। বিদ্যালয়ের অধিকাংশ জমি বাজারের মধ্যে অবস্থিত। অবৈধ দখলদাররা স্কুলের সম্পত্তিকে নিজস্ব মালিকানা হিসেবে দাবি করে বিভিন্ন সময়ে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে ব্যবসা বাণিজ্য করে আসছে। ইতোপূর্বে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি)-র নেতৃত্বে উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার সরেজমিনে পরিমাপ করে সীমানা নির্ধারণ করেন। কিন্তু অবৈধ দখলকারীগণ প্রভাব খাটিয়ে আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে নিজস্ব স্থাপনা নির্মাণ করছে। ওই বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করার কোন মাঠ নেই।
আরও পড়ুন : ইউনিফর্মের মর্যাদা নষ্ট হতে দেব না
এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে স্কুলের জমি তথা সরকারি জমি রক্ষার্থে উক্ত অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ করে স্কুলের সম্পত্তি দখলমুক্ত করে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের খেলাধুলা করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বারবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন দফতরে আবেদন করেও গত পাঁচ বছরে কোন সুরাহা হয়নি।
উপজেলার সাতৈর 'ক' ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. আয়ূব আলী মোল্যা ২০১৮ সালের ১০মে তৎকালীন ইউএনওর নির্দেশ মোতাবেক বোয়ালমারী ইউএনও বরাবর একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, 'চিতারবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে রেকর্ডীয় ৭৬ নং বাজিতপুর মৌজার ২ নং বিএস খতিয়ানের ১, ২, ৩১, ৩২, ৩৫ নং দাগের ৯৬ শতাংশ এবং ৭০ নং মোবারকদিয়া মৌজার বিএস ৬২০ খতিয়ানের ৪২৫ দাগের ৮ শতাংশ জমির মোট ৪ শতাংশসহ মোট ১০২ শতাংশ জমি ইউএনওর ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিলের এক নির্দেশ মোতাবেক স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে ২০১৮ সালের ১৩ এপ্রিল বিদ্যালয়ের জমি পরিমাপ করে সরেজমিনে দখল বুঝে দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি পরিমাপের সময় বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী কোন জমির মালিকগণই কোন প্রকার আপত্তি জানান নাই।'
আরও পড়ুন : যুক্তরাষ্ট্রে ধুলোঝড়ে নিহত ৬
এদিকে বিদ্যালয়ের জমি অবৈধভাবে যারা দখল করে রেখেছেন তাদের মধ্যে বিদ্যালয়ের সভাপতি হীরামন পারভীনের স্বামী মোবারকদিয়া গ্রামের মো. শাকিল মোল্যা, দেবর রাজু মোল্যাও রয়েছেন। মো. শাকিল মোল্যা ৭৬ নং মৌজার ২৩৩৮ নং খতিয়ানের ৩৫ নং দাগে আধা শতাংশ জমি দখল করে রেখেছেন।
এছাড়া দাদপুর গ্রামের মজিদ শেখের ছেলে মো. আবুল খায়ের দশমিক ৬০ শতাংশ, বাজিতপুর গ্রামের বিশাই শেখের ছেলে মো. আলমগীর পৌনে এক শতাংশ, একই গ্রামের কোহিনূর পৌনে এক শতাংশসহ অন্তত ৩৮ জন ব্যক্তি ওই বিদ্যালয়ের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা বসতবাড়ি গড়ে তুলেছেন। সম্প্রতি দাদপুর গ্রামের সিরাজুল বিশ্বাসের ছেলে ইসরাইল বিশ্বাস দখল করে রাখা বিদ্যালয়ের এক শতাংশ জমিতে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করছিলেন। খবর পেয়ে প্রশাসন ওই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন।
অবৈধভাবে বিদ্যালয়ের জায়গা দখল করে রাখা মুদি দোকানদার আবুল খায়ের বলেন, 'আমি যেখানে ব্যবসা করি সেটা স্কুলের জায়গা। আমি ছাড়াও আরো অনেকেই স্কুলের জায়গা দখল করে ব্যবসা করে আসছে, আমিও সেইভাবে ব্যবসা করছি।'
আরও পড়ুন : ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা, বাড়ছে তাপমাত্রা
অপর অবৈধ দখলদার কোহিনুর বলেন, 'আমি সামচুল হক বিশ্বাসের নিকট থেকে সোয়া এক শতাংশ জমি ক্রয় করেছি। কিছু দিন আগে বিদ্যালয় থেকে মাপার পর দেখছি আমার অর্ধেক জায়গা বিদ্যালয়ের। বিদ্যালয় দেয়াল তুললে আমি বিদ্যালয়ের জায়গা ছেড়ে দেব।'
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চিতারবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (চ.দা) রত্না রানী দে বলেন, 'প্রায় ২৫/৩০ বছর আগে থেকে স্কুলের ওই জায়গা স্থানীয়রা অবৈধভাবে দখলে রেখেছেন। বিদ্যালয়ের মোট ১২৫ শতাংশ জায়গার মধ্যে ২৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের দখলে আছে। অবৈধ দখলকারীদের হাত থেকে স্কুলের জমি উদ্ধারের জন্য আমি চলতি মাসেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাসহ আট জায়গায় আবেদন করেছি। জায়গা উদ্ধারের ব্যাপারে বিদ্যালয়ের সভাপতি আমাকে কোন সহযোগিতা করছেন না। এমনকি কোন কাগজেও তিনি স্বাক্ষর করছেন না। কারণ তারাও বিদ্যালয়ের জায়গা অবৈধ দখলে রেখেছেন।'
আরও পড়ুন : রাজউকের ২৬ হাজার নথি উদ্ধার
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হীরামন পারভীন বলেন, 'আমি কয়েক মাস হলো সভাপতি হয়েছি, এজন্য আমি বিদ্যালয়ের জায়গার অবৈধ দখল সম্বন্ধে ভালো বলতে পারবো না। আর আমার স্বামীর বিদ্যালয়ের জায়গায় কোন স্থায়ী দোকান নেই, অস্থায়ী একটি কাঁচা বাজারের দোকান আছে।'
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু আহাদ বলেন, 'দাদপুর গ্রামের সিরাজুল বিশ্বাসের ছেলে ইসরাইল বিশ্বাস তার দখলে রাখা বিদ্যালয়ের এক শতাংশ জমিতে সম্প্রতি পাকা স্থাপনা নির্মাণ করছিলেন। বিষয়টি ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাকে জানানো মাত্র আমি ইউএনও স্যারকে অবহিত করি। পরে ইউএনও স্যার আর আমি ঘটনাস্থলে যাই এবং ইউএনও স্যার ওই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন।'
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোশারেফ হোসাইন বলেন, 'প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর আমাদেরকে জানিয়েছে স্কুলের জায়গা দখল করে একাধিক ব্যক্তি দোকানঘর উত্তোলন করে ব্যবসা করছেন। আমরা প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি উপজেলা শিক্ষা কমিটি, সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ এবং চিতারবাজার বণিক সমিতি একসঙ্গে বসে দখলদারদের কাছে জানতে চাইবো, তারা কিভাবে বিদ্যালয়ের জায়গা দখল করে দোকানঘর করেছে। পুরো বিষয়টি জানার পর পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিবো কিভাবে জায়গাটি দখলমুক্ত করা যায়।'
সান নিউজ/এমআর