নিজস্ব প্রতিবেদক:
রংপুর: রংপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ফজলে এলাহী ফুল ও তার সহযোগীদের হামলায় গুরুতর আহত হলেও পরদিন ওই কাউন্সিলরেরই করা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে বাংলা টিভির রংপুর প্রতিনিধি রাফাত হোসেন বাঁধনকে। পুলিশ বাঁধনের করা মামলাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় কাউন্সিলর ফুল এবার প্রকাশ্যে থেকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে তার পরিবারের সদস্যদের।
এমনটি অভিযোগ করে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে বাঁধনের স্ত্রী ইয়াসমিন রাফাত বন্যার দেওয়া খোলা চিঠি ও বিবাহ বার্ষিকী নিয়ে দুটি ফেসুবক স্ট্যাটাসে সর্বত্র চলছে তোলপাড়। ওই স্ট্যাটাসের সঙ্গে সেদিনের ঘটনার সিসিটিভির ফুটেজসহ বিভিন্ন ডকুমেন্টও পোস্ট করেছেন তিনি।
পরিবারের সদস্যরা জানান, গত ৮ আগস্ট নগরীর ৩নং চেকপোস্ট এলাকায় নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাকিতে বিক্রি করা পণ্যের পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর ফুল ও তার সহযোগীদের সশস্ত্র হামলায় গুরুতর আহত হন সাংবাদিক বাঁধন। পরে উল্টো কাউন্সিলরের মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে।
তাদের অভিযোগ, হামলার পর সাংবাদিক বাঁধন কাউন্সিলর ফুলসহ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। এই মামলার পরদিন কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই পুলিশ কাউন্সিলর ফুলুর করা মামলা থানায় রেকর্ড করেন। মামলাটিকে সাজানো ও মিথ্যা বলে দাবি করে বাঁধনের পরিবারের সদস্যরা জানান, এ ঘটনায় সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের গড়া বৃহৎ সমবায়ী প্রতিষ্ঠান কফিডেন্স সেভিং অ্যান্ড ক্রেডিট- এও হামলা ও লুটপাট করে সন্ত্রাসীরা। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি মামলা দিলেও চারদিনেও তা রেকর্ড করেনি পুলিশ।
এ ঘটনা নিয়ে নগরীতে চলছে তীব্র ক্ষোভ। পরদিন ৯ আগস্ট রংপুরে কর্মরত সাংবাদিক সমাজ ২৪ ঘন্টার মধ্যে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে বাঁধনের মামলা রেকর্ড ও আসামি গ্রেপ্তারের দাবি জানালেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার হননি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাঁধনের মুক্তি দাবি এবং ঘটনার তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানানো অব্যাহত রেখেছেন সাংবাদিক, সাংবাদিক সংগঠন, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠন ও সুশীল সমাজের নেতারা।
কারাগারে থাকা বাঁধনের স্ত্রী বন্যা শুক্রবার (১৪ আগস্ট) ভোররাত সাড়ে তিনটায় নিজেদের কিছু ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন। যাতে দেখা যায়, ১৪ আগস্ট বাঁধন-বন্যার ৬ষ্ঠ বিবাহ বার্ষিকী। একটি জামদানি শাড়ির কথাও বলা হয় পোস্টটিতে। ঠিক এর আগের পোস্টটিতে সন্ত্রাসী হামলাকারী কাউন্সিলর ফুল, তার পুত্র শাওন ও সজল এবং আকিফুলসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দৃশ্যমান অবস্থান জানতে চেয়েছেন বন্যা। জানিয়েছেন সন্ত্রাসীদের উল্টো মেরে ফেলার হুমকিতে শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের নিয়ে তার নিরাপত্তাহীনতার কথাও। এটিতে তিনি রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেদিনের ঘটনার সিসিটিভির ফুটেজ এবং কাউন্সিলর ফুলুর কাছে পাওনা টাকার স্টিলচিত্রসহ বিভিন্ন ডকুমেন্ট উপস্থাপন করে তার স্বামী কারাগারে থাকার দায় কার বলেও প্রশ্ন তুলেছেন।
স্ট্যাটাস দুটি নেট দুনিয়ায় হয়েছে ভাইরাল। হাজারো মানুষ শেয়ার-কমেন্টস করে সমবেদনার পাশাপাশি সাংবাদিক বাঁধনের মুক্তি ও হামলাকারী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান। বিভিন্ন গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
পরে দেওয়া পোস্টটি হুবহু এরকম- ‘আজ আমাদের ষষ্ঠ বিবাহ বার্ষিকী। প্রতিবছরের ন্যায় বারোটা এক মিনিটে আমার স্বামী আমাকে উইশ করে এবং ফ্যামিলি সহ কেক কাটে। কিন্তু আজ আর সে আমার পাশে নেই, উইশ করার কেউ নেই। অনেক কষ্ট লাগছে, খুব একা মনে হচ্ছে। সে বলেছিল, আমাকে এবার জামদানি শাড়ি পরাবে, কিন্তু জামদানি আর পরা হলো। কখনো ভাবিনি এইদিনটা ওকে ছাড়া কাটাবো। এটা কি আমার প্রাপ্য ছিল? এই বিশেষ দিনে সে আমার পাশে নেই।’
এর আগে দেওয়া বাঁধনের স্ত্রী বন্যার স্ট্যাটাসটি হুবহু এ রকম-
‘মাননীয় রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি।’
‘আমি বাংলা টিভির রংপুর প্রতিনিধি রাফাত হোসেন বাঁধনের স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার বন্যা বলছি। আমার শ্বশুর সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা আফজাল হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাঁধন ট্রেডার্স থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিভিন্ন সময়ে বাকিতে ক্রয় করেন রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফজলে এলাহী ফুলু। বিভিন্ন সময়ে আমার শ্বশুর তার কাছে টাকা চাইতে গেলে তিনি টালবাহনা করেন। গত ৮ আগস্ট আমার শ্বশুর বাকি টাকা চাইতে গেলে তার ওপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় কাউন্সিলর ফুলু ও তার পুত্র শাওন, সজল, আকিফুলসহ একদল সন্ত্রাসী।’
‘বিষয়টি জানতে পেরে আমার স্বামী বাঁধন অফিস থেকে দ্রুত আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে আসলে কাউন্সিলর ফুলু, আকিফুল, শাওন, সজলসহ অন্যান্যরা আমার স্বামীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় আঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশের উপস্থিতিতে তাকে তার সহকর্মীরা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। আমার স্বামী এবং শ্বশুরের ওপর হামলার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আমি আপনার কাছে এই আইডির মাধ্যমে নিবেদন করলাম। যারা আমার স্বামীকে মারলেন, সেই কাউন্সিলর ফুলুর মিথ্যা মামলাটি কিভাবে তদন্ত ছাড়াই পুলিশ রেকর্ড করলো, এটি একজন নারী হিসেবে আমার কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। মামলার নথির সাথে কাউন্সিলর ফুলু তার সন্ত্রাসী বাহিনীর কয়েকজনের মাথায় মুরগির রক্ত দিয়ে ছবি সংযুক্ত করে দিল। সেই মিথ্যা মামলায় আমার স্বামী এখন অন্ধকার কারাগারে। অথচ আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। কতো কিছু করবো, পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। তা আর হলো না।’
‘মাননীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়,’
‘আমি আপনার কাছে বিনয়ের সাথে জানতে চাই। একটি মিথ্যে মামলায় যদি আমার স্বামী অন্ধকার কারাগারে থাকে। তাহলে কি কারণে এখনও হামলাকারী কাউন্সিলর ফুলু এবং তার অন্যান্য সহযোগীরা বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনি দয়া করে এই সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজটি কি একটু দেখার সময় পাবেন।’
‘আমি রংপুরের সকল সাংবাদিক, সুধীমহল, নগরবাসী, প্রধানমন্ত্রীসহ সারা দেশবাসীর কাছে এই দাবি জানাচ্ছি যে, কাউন্সিলর ফুলু চেক জালিয়াতি মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি এই ভয়াবহ চেক জালিয়াতির মামলাটির তথ্য গোপন করে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং আমার স্বামী বাঁধনের মামলার প্রধান আসামি। তিনি কি আইনের ঊর্ধ্বে। তিনি এখনও প্রকাশ্যে অফিস করছেন। ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমাদেরকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন।’
‘মাননীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছে বিনয়ের সাথে জানতে চাই, যদি একটি নির্লজ্জ মিথ্যা মামলায় আমার স্বামী বাঁধন তার আড়াই বছরের শিশু সন্তানকে রেখে অন্ধকার কারাগারে রাতযাপন করে, এই দায় কার। ইতি- ইয়াসমিন রাফাত বন্যা।’
সান নিউজ/ এআর