আসাফুর রহমান কাজল:
“বাজারে আমাগের চা’র কাপ আলাদা। ডান্টি ছাড়া ভাঙ্গা চা’র কাপ আমাগে জন্যি। আর ভাল চা’র কাপ তাগের জন্যি”। রঙ ফিকে হয়ে আসা ছেঁড়া লুঙ্গির এক কোনা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন যশোরের কেশবপুর উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের প্রভাস দাস।
অস্পৃশ্যতার অভিশাপ নিয়ে সমাজের প্রায় সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে দিন-রাত যেন একাকার হয়ে আছে কেশবপুরের প্রায় অর্ধলাখ মানুষের জীবনে। কেশবপুর উপজেলার আড়াই লাখ মানুষের মধ্যে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা চল্লিশ হাজারেরও বেশি। ঋষি, শব্দকর, বেদে, তৈলী, হাজাম, দাই, ধোপা, মানতা, চন্ডাল, মুচী, ডোম, চাড়াল, রবিদাস, রুহীদাস, বেহারা, মেছো কৈর্বত, জলদাস, নিকারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন এই সম্প্রদায়ে।
আধুনিক এই সমাজে এখনও পদে পদে লাঞ্চনার শিকার হচ্ছেন দলিত সম্প্রদায়ের মানুষেরা। অর্থ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার অভাবে দলিত সম্প্রদায়ে মানুষেরা যুগ যুগ ধরে পৈতৃক পেশাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছেন। সরকার বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করলেও এই জনগোষ্ঠির বাবা-মায়ের মধ্যে সন্তানকে স্কুলমুখী করার প্রবনতা অনেক কম। পড়াশুনার খরচ চালানোটা তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে উঠায় সন্তানদের বরং বিভিন্ন কাজে পাঠাতেই উৎসাহী তারা। পরিণতিতে বাড়ছে শিশুশ্রম। কোন কোন শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেলেও তাদেরকে থাকতে হয় অচ্ছুৎ, বসতে হয় পেছনের বেঞ্চে, শুনতে হয় গাল-মন্দ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাগরদাঁড়ী ইউনিয়নের কাঁস্তা গ্রামের দশম শ্রেণীতে পড়া এক ছাত্র জানায়, “আমরা দলিত বলে গ্রামের কাছে স্কুল কলেজে পড়তে অনেক অসুবিধা হয়। অন্যরা মুচি-মেথরের বাচ্চা বলে গালি দেয়। আমাদের সাথে কেউ মিশতে-খেলতে চায় না, বন্ধুত্ব করে না, তাই পরিচয় গোপন রেখে দূরের স্কুল কলেজে পড়ি।”
একই ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া, কাঁস্তা, বাড়ইহাটি, ধর্মপুর, চিংড়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ বাড়িতে নেই সুপেয় পানি, নেই স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যবস্থা। সুপেয় পানির অভাবে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন এখানকার মানুষগুলো।
শিশুরা অপুষ্টির সাথে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগ, হাপানীসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাশাপাশি স্যানিটেশনের অভাবে নারীদের ভূগতে হচ্ছে যৌন সংক্রান্ত নানা রোগে।
শিক্ষার অভাব আর মূল জনগোষ্ঠির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে দেশিয় মদ, গাঁজা, ডান্টিসহ নানা মাদকে আসক্ত হচ্ছেন এলাকার পুরুষেরা। ফলে যক্ষা, কিডনি-লিভার ইনফেকশন, ক্যন্সার, আলসারের মত রোগে আক্রান্ত বাড়ছে নারী পুরুষ সবাই।
গ্রামগুলোতে অধিকাংশ মানুষ পুকুর ও অগভীর নলকুপের উপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ টিউবয়েলের পানি আয়রণযুক্ত। হাট-বাজার, ড্রেন, রাস্তা, অফিস-আদালত, টয়লেট পরিস্কার রাখেন যারা, তারাই রয়েছেন নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।
বাঁশবাড়িয়া গ্রামের নেতো দাসী বলেন, “ছোট থাকতি বিদবা হইছি। আইজও কোন ভাতার কাড পাইনি। কাড চাইতে গেলে ৩/৪ হাজার টাকা চায়, টাকা যারা দিছে তারা কাড পাইছে। অসুস্থ ছাওয়াল মাঝে মাঝে জুতা সেলাই করে, তাতে সংসার চলে না। তাই আমারও হাত পাততি হয়। তিন বেলা খাতি পারি না, ছাওয়ালরে ডাক্তর দেহাবো কি দিয়ে”।
আজও কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করা হয় দলিত সমাজে। বাল্য বিবাহের ঘটনা এখানে ঘরে ঘরে। মেয়েদের আঠরো বা ষোলর আগেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। সৌভাগ্যবশত কোন মেয়ে কলেজের বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেও আর্থিক অভাবের কারণে মাঝপথেই ইতি টানতে হয় পড়াশুনার। বরং মেয়ের বিয়েতে যৌতুকের টাকা যোগাতেই ব্যস্ত হয়ে উঠেন বাবা-মা।
সমাজের উন্নয়নমূলক কোন কাজে অংশ নিতে গেলেও রয়েছে বাঁধা। বাজার, স্কুল, কলেজ কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কোন কমিটিতে স্থান দেয়া হয় না তাদের কাউকে। ছোটখাটো ব্যবসার জন্য বাজারে দোকান দিতে গেলেও হতে হয় বাঁধার সন্মুখীন। এমনকি স্বাভাবিক কোন কিছু কেনাকাটা করতে গেলেও পড়তে হয় নানা ধরণের সমস্যায়। অনেক সময় দোকানের ভেতর পর্যন্ত ঢুকতেও দেয়া হয় না তাদেরকে।
এছাড়া জাতপাতের দৃষ্টিতেও সীমাহীন বৈষম্যের শিকার তারা। পূঁজাতে প্রতিমা দেখতে হয় দূর থেকে, নিচু জাত বলে মন্দিরে প্রবেশের সীমানা পেরোনো মানে পরের জন্মে কুকুর বিড়াল হয়ে জন্ম নেওয়া। ব্রাক্ষ্মন ঠাকুরদের ছায়া মাড়িয়ে গেলে তো ইহকাল-পরকাল সব শেষ! নিজ এলাকায় ছোট মন্দির করলেও জোটেনা পূজারি ও প্রতিমা। দলিত সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় কোন আনুষ্ঠানিক কাজেও আসতে চায় না কোন ব্রাক্ষ্মন পুরোহিত।
শুধুমাত্র দলিত জনগোষ্ঠির মানুষ হওয়ার কারণে চিতা থেকে মরদেহ ফেলে দিয়েছে উচ্চ বংশীয়রা। এমন ঘটনাও রয়েছে। বেসকারি উন্নয়ন সংস্থা পরিত্রাণ এর নির্বাহী পরিচালক মিলন দাস বলেন, “মরদেহ’র কোন জাত আছে কিনা, আমার জানা নেই। আমরা এইসব অবহেলিত দলিত জনগোষ্ঠির মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি। সরকারের এসডিজি বাস্তবায়নের মুল স্লোগানই হল ‘কাউকে পিছনে ফেলে নয়’। এখন সময় এসছে এসব মানুষকে নিয়ে ভাববার। বেশ কয়েকটি বেসরকারী সংস্থার আর্থিক সহায়তায় কেশবপুরে অঞ্চলের দলিতদের নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
দলিতদের মুক্তির আন্দোলন বাংলাদেশ দলিত পরিষদের (বিডিপি) কেশবপুর উপজেলা কমিটির সভাপতি সুজন দাস বলেন, জন্মের পর থেকে আমরা সমাজপতি, উচ্চবর্ণ এবং প্রভাবশালীদের কাছে লাঞ্চিত হচ্ছি। আমাদের দেখার কেউ নেই। লাঞ্চনা-বঞ্চনা আমাদের নিত্য সঙ্গি। সভ্যতার এ যুগেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল স্থানে আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি।
বাংলাদেশ দলিত পরিষদ (বিডিপি) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি উদয় দাস জানান, বৈষম্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ‘বৈষম্য নিরোধ আইন’ এখন সময়ের দাবী। স্বাধীন দেশে আজও দলিত শ্রেণীর মানুষ স্বাধীনভাবে চলতে, বলতে বা কোন কাজ করতে পারে না।