হারুন উর রশিদ সোহেল, রংপুর থেকে:
রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় বন্যার ধকল কাটতে না কাটতেই ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি। এতে মানুষের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে গবাদিপশুও। কিন্তু নেই চিকিৎসাসেবা সহায়তা।
সাম্প্রতিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি বানভাসিরা। এসব মানুষের কাজ নেই, হাতে নেই টাকা-পয়সা। ঘর-বাড়ি মেরামত, ভেঙেপড়া নলকূপ ও লেট্রিন সংস্কার নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। তাদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ফলে এখনও এসব মানুষেরা ভুগছেন নিজেদের পাশাপাশি গবাদিপশুর খাদ্য সংকটে। এরই মধ্যে রোগ-ব্যাধি যেন ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’। সব মিলিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
সূত্রে জানা গেছে, চলতি বন্যায় রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, হারাগাছ, পীরগাছা ও পীরগঞ্জ, লালমনিরহাট জেলার সদর, তিস্তা, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারি ও দহগ্রাম, নীলফামারীর জলঢাকা, ডিমলা ও কিশোরীগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গোবিন্দগঞ্জ এবং কুড়িগ্রাম জেলার সদর, রাজারহাট, চিলমারি, রাজিবপুর, উলিপুর, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি, রৌমারি উপজেলাসহ এ অঞ্চলের ১০ লাখ মানুষ নদীভাঙন ও জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন। অসংখ্য ঘর-বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অনেকেই সব কিছু হারিয়ে পথে বসেছেন। এর মধ্যে পানিতে ডুবে প্রায় ২৫ জনের মৃত্যুও হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা এবং লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর অঞ্চলে বন্যার পানি বিপদসীমার ওপর থেকে কমতে শুরু করার পর থেকে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। চরাঞ্চলের মানুষদের হাত, পা ও আঙ্গুল ফেটে যাচ্ছে, শরীরে বাসা বাধছে নানা জটিল রোগ। স্বাস্থ্যবিভাগ বন্যাকালে মেডিকেল টিম গঠনের কথা বললেও দুর্গম চরাঞ্চলে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হাজার হাজার চরাঞ্চলবাসী।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার সিদ্দিক আলী বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের মশালেরচর গ্রামটি নদীবেষ্টিত। এখানে প্রায় তিন শত পরিবার রয়েছে। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে গরু-ছাগলের রোগ দেখা দিয়েছে। গরু ভুগছে লাম্পি স্কিন ডিজিজে। বাড়ির পুরুষ ও নারীরা হাত ও পায়ের চর্মরোগ এবং শিশুরা সর্দি, কাশি ও পাতলা পায়খানায় আক্রান্ত হয়েছেন।’
৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবু বক্কর খান বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের বতুয়াতুলি ও ফকিরেরচর গ্রামে ১৯৭টি পরিবারের মাঝে প্রায় অর্ধেক পরিবারে নারী-পুরুষের চর্মরোগ ও গরুর রোগ দেখা দিয়েছে। প্রতিটি গরুর চিকিৎসা বাবদ আড়াই হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে। এতে কর্মহীন মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। চরগুলোতে ডাক্তার না থাকায় নৌকা ভাড়া করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করতে অনেক ব্যয় হচ্ছে। এতে হাঁফিয়ে উঠছেন চরের মানুষজন।
চিলমারির আষ্টমীরচর গ্রামের আলম মিয়া ও রাজিবপুরের বাইটকামারী গ্রামের রিপন মিয়া বলেন, ‘আমাদের চরাঞ্চলে সরকারি কোনো পশু ডাক্তার আসেন না। আমাদের বাড়তি ব্যয়ে নৌকা ভাড়া করে উপজেলা সদরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়।’
লালমনিরহাটের মহিষখোচার আমিনুল হক, রেজাউল করিমসহ বেশ কয়েকজন বলেন, ‘চরের সম্পদ হল গরু। এই গরু না থাকলে আমরা বাঁচবো কিভাবে?’
চরাঞ্চলের মানুষরা দাবি করেন, ‘আমাদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে সরকার যদি সপ্তাহে একবার করে চরগুলোতে ডাক্তার পাঠানোর ব্যবস্থা করে, তাহলে চরের মানুষ সঠিক চিকিৎসাসেবা পাবেন। না হলে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ বাগিয়ে নিচ্ছেন এলাকার পল্লী চিকিৎসকরা।’
কুড়িগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের আশঙ্কা রয়েছে যে, বন্যা পরবর্তীতে পানি নেমে যাওয়ার পর পানিবাহিত রোগগুলো বিস্তার লাভ করতে পারে। এজন্য আমাদের ৮৫টি মেডিকেল টিম প্রস্তুুত রয়েছে।’
কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মকবুল হোসেন জানান, ‘লাম্পি স্কিন ডিজিজ মূলত ভাইরাল ডিজিজ। মশা-মাছি থেকে এটি ছড়িয়ে পরে। এতে গরু মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে চিকিৎসায় অবহেলা করলে মারাও যেতে পারে। এখনো যে সমস্ত চর এলাকায় আমাদের লোকজন যেতে পারেননি, দ্রুত সেগুলোতে ভ্যাকসিন নিয়ন্ত্রণ ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া হবে।’
রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমার রায় বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ডায়রিয়া ও নিউমেনিয়াসহ অন্য রোগের সেভাবে প্রার্দুভাব দেখা যায়নি। আমাদের মেডিকলে টিম প্রস্তুুত রয়েছে।’
সান নিউজ/ এআর