এম এ আজিজ রাসেল: মানব পাচারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কক্সবাজার। এই জেলায় মানব পাচার নিয়ে সর্বোচ্চ মামলা রয়েছে। মামলাগুলো গতি বাড়াতে হবে। করোনা আসার পর এখন অনলাইনেও মানব পাচার হচ্ছে। দেশের কিছু মানুষ দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে মানব পাচারের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও ভূমধ্যসাগর দিয়ে গ্রীসে পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকেই। যার সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাই মানব পাচারের রোড ক্রস বের করে সমন্বিত প্রচেষ্টায় প্রতিরোধ ও দমন করতে হবে মানব পাচার।
রোববার (২৩ অক্টোবর) সকালে কলাতলীর একটি তারকা মানের হোটেলের বলরুমে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন বিষয়ক জাতীয় কর্মশালা ২০১৮-২০২২ বাস্তবায়ন এবং হালনাগাদকরণ বিষয়ক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় এই কর্মশালার আয়োজন করে।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আখতার হোসেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, "মানব পাচার একটি ক্রমবর্ধনশীল সংঘবদ্ধ অপরাধ। এটি আন্তঃসীমান্ত মানব পাচার অন্যতম বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাই মানব পাচারের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক পদক্ষেপ হিসেবে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন দলিল এবং জাতীয় পর্যায়ে আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অনেক সময় বিদেশে নেওয়ার কথা বলে দেশের বিভিন্ন উপকূলে নামিয়ে দেওয়া হয়। এটি নির্দয় প্রতারণা। কারা কিভাবে মানব পাচার করে তা সবাই জানে। তাঁদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবে ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের নৈতিক দায়িত্ব বেশি। পাচারে জড়িতদের আইনের কাছে সোপর্দ করুন। আর পাচার হওয়া মানুষকে বোঝাতে হবে এর ভয়াবহতা। প্রয়োজনে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই বাড়বে দেশের সম্মান। "
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশ সরকার সব ধরনের মানব পাচার, বিশেষ করে নারী ও শিশু পাচার দমনে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নতুন আইন প্রণয়ন, এর যুগোপযোগী সংস্কার এবং বিধিমালা তৈরি করার পাশাপাশি পাচার বিরোধী বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার, নাগরিক সমাজ সবার মাধ্যমে সুদৃঢ় ও সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০০২ সাল থেকে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে আসছে। সরকার এ পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে তিনটি বাস্তবায়ন করেছে। জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বিগত কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানে নতুন জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-২০২২) গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রথম পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, আগেরগুলো ছিলো তিন বছর মেয়াদী।"
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আশরাফ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) এ কে এম টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি অনুবিভাগ) এ কে এম মুখলেছুর রহমান, জেলা প্রশাসক মোঃ মামুনুর রশীদ, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস, বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছিন পারভীন তিবরীজি, চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মোঃ বদিউল আলম, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোঃ মাহফুজুল ইসলাম, খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মোঃ নাঈমুল হক, বান্দরবানের পুলিশ সুপার মোঃ তারিকুল আলম ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কবীর আহম্মদ।
বক্তারা বলেন, "মানব পাচারে আইন প্রয়োগে জটিলতা রয়েছে। বাস্তবায়নও দুরূহ। একটি সফটওয়্যার তৈরি হলে শক্তিশালী হবে নেটওয়ার্কিং। আর তাতে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে কর্মকর্তাদের মাঝে। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ভারতে অসংখ্য নারী পাচার হচ্ছে। তাই শুধু কর্মশালা নয়, মানব পাচার প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।"
সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আশরাফ উদ্দিন বলেন, "পাচারের জন্য এখন মূল রুট ভূমধ্যসাগর। গত ৭ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২০ লাখ মানুষ পাচার হয়েছে। আর এতে পানিতে ডুবে মারা গেছে ১৯ হাজার। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ফ্রন্ট ইয়ার জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে আটক হয়েছে অসংখ্য বাংলাদেশী। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। একবার লিবিয়ায় ২৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মনে রাখতে হবে মানব পাচারের মামলা হওয়ার পর দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। বিচারে শাস্তি না হলে পাচারকারীরা ভয় পাবে না।"
এতে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনার পটভূমি উপস্থাপন করেন ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী ও উইনরক ইন্টারন্যাশনালের চীফ অব পার্টি লিসবেথ জোনাল্ড।
সমাপনী বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ ও এনটিএমসি) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম।
কর্মশালা সঞ্চালনা করেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আবু সুফিয়ান।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত কর্মশালার কারিগরি সহযোগিতায় ছিল এফএসটিআইপি অ্যাকটিভিটি ও উইনরক ইন্টারন্যাশনাল।
পরে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২০২২ এর বাস্তবায়ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার উপর ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে দলগুলো মানব পাচারকারীদের তালিকা তৈরি, কমিটির কার্যক্রম বৃদ্ধি, রোহিঙ্গা পাচারকারীদের চিহ্নিত ও মানব পাচারের রুটে নজরদারি বাড়ানোর মতামত ব্যক্ত করা হয়।
সান নিউজ/এসআই