হারুন উর রশিদ সোহেল, রংপুর থেকে:
রংপুর নগরীসহ জেলায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু এখনো ভাঙন থামেনি। তিস্তা ও ঘাঘটসহ নদ-নদীগুলোতে তীব্র ভাঙনে আতঙ্কে দিশেহারা নদীপাড়ের হাজারও মানুষ। মারাত্মক হুমকির মুখে লহ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ এলাকায় তিস্তার বন্যা নিয়ন্ত্রণ মূল বাঁধটি।
পানির তোড়ে গঙ্গাচড়া উপজেলার দুই ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ ও বাড়িঘর।
শ্রাবণের বর্ষণ আর উজানের ঢলে তিস্তা ও ঘাঘটবেষ্টিত নিম্নাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মক ক্ষতির মুখে। অশান্ত তিস্তার স্রোতে নদীপাড়ে ভাঙন থামছেই না। বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি-ঘর, গাছপালা আর বসতভিটা, আবাদী জমি ও ক্ষেতের ফসল নদীর পেটে চলে যাচ্ছে।
গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, হারাগাছ, পীরগাছা, তারাগঞ্জ উপজেলাসহ রংপুর মহানগরীরও বেশ কিছু এলাকায় ছোট ছোট ব্রিজ, কালভার্ট ও যান চলাচলের সড়ক মারাত্মক ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। কোথাও কোথাও বাঁধের পাশাপাশি ব্রিজ ও কালভার্টের সংযোগ সড়ক ধসে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, গঙ্গাচড়ায় তিস্তার বন্যা নিরfপত্তা বাঁধের তিনটি অংশে প্রায় ১৩০ মিটার অংশ ধসে পড়েছে। সেখানকার আলমবিদিতর ইউনিয়নের পাইকান আকবরিয়া ইউসুফিয়া ডিগ্রি মাদ্রাসার সামনে তিস্তার স্রোতে ধসে পড়েছে ৬০ মিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এতে ওই মাদ্রাসাসহ পাশের পাইকান জুম্মাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাউদপাড়া আলিম মাদ্রাসা ও বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও হাজার খানেক পরিবার হুমকির মুখে পড়েছে। ওই ইউনিয়নের গাটুপাড়ায় ৪০ মিটার ও বেরাতিপাড়ায় ৩০ মিটার এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সিসি ব্লকও ধসে গেছে।
ভাঙন ঠেকাতে সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবি) জিও ব্যাগ ফেলতে শুরু করেছে। তবে চাহিদার তুলনায় জিও ব্যাগের সংখ্যা অনেক কম বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
লহ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহেও তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে গত সাতদিন ধরে। গত তিনদিনে এ গ্রামের প্রায় ৩৫০টি ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে শংকরদহ হাফিজিয়া মাদ্রাসা। ঘর-বাড়ি ও মাদ্রাসা বাঁচাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধে কাজ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।
লহ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ্ আল হাদী বলেন, তিস্তা নদীর পানি ক্রমাগত বাড়ছে। নদীর তীব্র স্রোতে শংকরদহে তিনদিনে প্রায় ৩৫০টি ঘর-বাড়ি ভেঙে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড তিন হাজার জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন প্রতিরোধে কাজ করলেও এখানে কমপক্ষে ১৫ হাজার জিও ব্যাগ প্রয়োজন। পানি আরও বাড়লে শেখ হাসিনা সেতু সংলগ্ন রংপুর-লালমনিরহাট সড়কটি ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নদীশাসন না হওয়ায় এবার তিস্তা আগ্রাসী রুপ নিলে লহ্মীটারীর কমপক্ষে ৫০ হাজার পরিবারের ঘর-বাড়ি ভেঙে নদীগর্ভে চলে যাবে।
গঙ্গাচড়ার কোলকোন্দ ইউনিয়নের চরচিলাখাল, মটুকপুর, বিনবিনার চরের প্রায় শতাধিক ঘর-বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বলে জানান ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন রাজু।
নোহালী ইউনিয়নের ফোটামারি ‘টি হেড গ্রোয়েন’ ও আলসিয়াপাড়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ মূল বাঁধ ভাঙনের মুখে পড়ায় সেখানেও জিও ব্যাগে বালু ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সড়ক ভেঙে যাওয়ায় গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক থেকে গাউছিয়া বাজার এবং পূর্ব রমাকান্ত থেকে গাউছিয়া বাজারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে।
এখন পর্যন্ত গঙ্গাচড়ায় তিনটি ব্রিজের সংযোগ সড়ক ধসে গেছে। উপজেলার দুই ইউনিয়নের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। রুদ্রেশ্বরের একটি ব্রিজের সংযোগ সড়কের ৪০ ফুট ধসে যাওয়ায় গঙ্গাচড়ার লক্ষীটারী ইউনিয়নের বিনবিনার চর, পূর্ব ইচলী, পশ্চিম ইচলীসহ পাঁচ গ্রামের হাজারো মানুষ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
মর্ণেয়ার শেখপাড়ায় ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের ব্রিজটির সংযোগ সড়কের মাটি পানির তোড়ে ধসে গেছে। এতে হাজীপাড়া, মর্ণেয়া, আনন্দবাজারসহ আশপাশের গ্রামের কয়েক হাজার মানুষের ব্রিজ দিয়ে চলাচলে দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়াও মর্ণেয়া ইউনিয়নে জমচওড়ার ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের ব্রিজের সংযোগ সড়ক ভেঙে জমচওড়া, আলালেরহাট, ছালাপাকসহ আশপাশ এলাকার দুই হাজারের বেশি মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
তারাগঞ্জ উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের চকতাহিরা-দর্জিপাড়া রাস্তায় অবস্থিত ব্রিজ দেবে প্রায় ২০ ফুট সড়কটি ভেঙে গেছে। এতে করে ১০টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। প্রায় ৩২ বছর আগে নির্মিত ব্রিজটির ডানদিকের দুইটিই গাইড ওয়াল ভেঙে গেছে। এতে ব্রিজটির বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন থেকে মেরামতের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় ব্রিজটি এখন হুমকির মুখে।
কাউনিয়াতেও তিস্তা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের শতাধিক স্থানে ধস দেখা দিয়েছে। এতে বাঁধটি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। সেখানকার হারাগাছ, বাংলাবাজার, ঠাকুরদাস, নাজিরদহ, বকুলতলা, মেনাজবাজারসহ আশপাশের ১৫টি গ্রামের মানুষের মধ্যে ভাঙন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
কাউনিয়ার ঠাকুরদাস, বকুলতলা এলাকার পশ্চিম দিকে তিস্তা ডানতীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ধসে ৫ থেকে ৭ ফিট করে বড় বড় গর্ত দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নজরদারির অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও তাম্বুলপুরের বিভিন্ন গ্রামেও ভাঙন দেখা দিয়েছে।
এছাড়াও বন্যার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাগঞ্জ, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নের প্রায় দুই শতাধিক বাড়ি-ঘর ও শত শত একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সেখানেও হুমকির মুখে আছে যোগযোগ ব্যবস্থা।
আষাঢ়ের বৃষ্টিতে রংপুর মহানগরীর দমদমা ব্রিজ, লক্ষণপাড়া ও শরেয়ারতল মোল্লাপাড়ার সড়কেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানির তোড়ে ওই গ্রাম দুটির মূল সড়কে সৃষ্ট ভাঙনে কয়েক হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। নগরীর নিচু এলাকাগুলোতে বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে কাঁচা রাস্তার পাশাপাশি পাকা সড়কেরও ক্ষতি হয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জানান, ভাঙন রোধে তিস্তাসহ অন্যান্য নদী এলাকায় খোঁজ নিয়ে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। বাঁধ রক্ষায় বিভিন্ন প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। অনেক জায়গায় জরুরি ভিত্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনসহ স্থানীয়রা মিলে ধস মোকাবেলায় কাজ করা হচ্ছে। বন্যার কারণে হুমকির মুখে থাকা যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি খেয়াল রয়েছে। ভাঙন রোধে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে ব্রিজগুলো রক্ষা ও সংযোগ সড়ক তৈরিতে ব্রিজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, এলজিইডি বা জেলা পরিষদ পরিকল্পনা ছাড়াই তাদের সুবিধামতো সংস্কার কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সান নিউজ/ এআর