শওকত জামান, জামালপুর: শিশুকাল থেকেই স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। মা ডাক্তার লুৎফর নাহার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফিরে এপ্রোন ও টেটিস্কোপ রেখে দিলে সেই এপ্রোন পড়ে ও টেলিস্কোপ নিয়ে খেলার ছলে বলতেন বড় হয়ে মা আমি তোমার মতো ডাক্তার হবো। মানুষের সেবা করবো। এই স্বপ্ন লালন করেই বেড়ে উঠেন তিনি। স্কুল, কলেজ ও মেডিকেল কলেজে মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর করেছেন তার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে। হয়েছেন সফলও। গল্পটি বলছি ডা. সানজিদা ইসলামের।
আরও পড়ুন: সমান তালে চলছে আক্রান্ত ও সুস্থতা
ডাক্তার হবার স্বপ্নে বিভোর সেই শিশুটি আজ বর্তমানে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে প্রসুতি ও গাইনি বিভাগে সহকারী সার্জন হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। চিকিৎসা সেবায়ও দক্ষতা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলছেন তিনি। ফ্রিতে চিকিৎসা সেবা দেয়ার পাশাপাশি গাঁটের পয়সা খরচ করে ওষুধ কিনে দেন দরিদ্র রোগীদের। তার মমতাময়ী ব্যবহারে রোগীরা অনেকটাই সুস্থ্য হয়ে উঠেন। তারপর তার প্রেসক্রিপশনে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে রোগীরা বাড়ি ফিরে যান হাসিমুখে। মানবতা ও সেবায় তিনি জামালপুরের দরিদ্র রোগীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ডাক্তার আপা নামেই চেনেন সবাই।
হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার নেটওয়ার্ক চিকিৎসা ও মানব সেবায় বিশেষ অবদান রাখায় তাকে মাদার তেরেসা স্বর্ণপদকে ভূষিত করেছেন।
সানজিদা ইসলামের জন্ম ১০ অক্টোবর ১৯৮৪ সালে ময়মনসিংহ শহরের কৃষ্টপুর গ্রামে। সেখানেই প্রকৃতিক পরিবেশে দুরন্তপনায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। সেখানেই কেটেছে শৈশব ও কৈশরের সোনালী দিনগুলো।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে কমছে জ্বালানি তেলের দাম
বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা রফিকুল ইসলাম ও ডা. লুৎফর নাহার দম্পত্তির বড় মেয়ে ডাক্তার সানজিদা ইসলাম। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন জামালপুর শহরের গোলাপবাগ এলাকায় সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের সাবেক উপাধক্ষ্য.. ছেলে শাম্মুর সাথে।
পড়ালেখায় হাতে খড়ি পাদ্রী মিশন স্কুলে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্কুল বিতর্ক ও কবিতা আবৃতি, গার্লস গাইড ও খেলাধুলায়ও রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। কৃত্বিত্বের সাথে বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও মমিনুন্নিসা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন কমিউনিটি বেইজড মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। বিসিএস (স্বাস্থ্য) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
আরও পড়ুন: চিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব
ডাক্তারি পাশ করে ২০১০ সালের ৪ জুলাই যোগদান করেন ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পরে বদলী হয়ে আসেন জামালপুর জেনারেল হাসপতালে।
জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের কর্মরত নার্স ও ওয়ার্ড বয় বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৯ সালের দিকে। একদিন সিএনজি করে দু'পা কাটা অজ্ঞাত এক ব্যক্তিকে ইর্মাজেন্সি বিভাগে ফেলে রেখে যায়। কাটা পা থেকে রক্ত ঝরছিল। সেদিন ইনডোর ডিউটি ডা. সানজিদা ইসলামের। রোগীর খারাপ অবস্থা দেখে হাসপাতালের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ডাক্তার সানজিদা। তাকে রেফার্ড করে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। সেই রোগীকে রেফার্ড করা হলে পথেই রক্তক্ষরণে মারা যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। ডা. সানজিদা নিজ দায়িত্ব নিয়ে ইমার্জেন্সিতে দু'পা সেলাই করার ব্যবস্থা করেন। পরে জরুরি ভিত্তিতে রক্তের ব্যবস্থা করে শরীরে রক্ত পুশের ব্যবস্থা করেন।
আরও পড়ুন: চার সাংবাদিকের ওপর হামলা
ওষুধসহ যাবতীয় খরচ বহন করেন তিনি নিজেই। চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে সুস্থ্য করে তুলেন নাম পরিচয়হীন অসহায় ওই রোগীকে। এমনই মানবতার টানে এগিয়ে যাওয়ার নানা গল্প রয়েছে ডা. সানজিদা ইসলামকে ঘিরে। করোনার সময়ও দমে যাননি তিনি। ভয়কে জয় করে নিজের জীবনকে বাজি রেখে করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে গেছেন নিরলসভাবে। এভাবেই পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা ও গাঁটের পয়সায় ঔষদ কিনে দিয়ে মানবসেবায় কাজ করে চলছেন এই ডাক্তার আপা।
ডা. সানজিদা ইসলাম বসবাস করেন শহরের গোলাপবাগ এলাকায়। কথা হয় গোলাপবাগের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন সুজনের সাথে। তিনি বলেন আমাদের এলাকার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে ছুটে যান ডা. সানজিদা আপার কাছে। তিনি বিনামূল্যে চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ওষুধও দিয়ে দেন। রাত-বিরাতেও এলাকার রোগী দেখেন। কোন সময় না শব্দটি শুনিনি। বিরক্ত হতেও দেখি নাই। হাসিমুখে এলাকার রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ডাক্তার আপা।
আরও পড়ুন: বিএনপি দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র করতে চায়
ডা. সানজিদা ইসলাম বলেন, শিশুকালের স্বপ্ন ছিল আমি লেখাপড়া শিখে ডাক্তার হব। ডাক্তার হয়ে আমার মায়ের মত মানুষের সেবা করে যাবো। পিতা-মাতার সে স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছি। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশি টাকার প্রয়োজন হয় না। তাই যতটুকু প্রয়োজন সেটুকু করি। আর বাকি সময়টুকু মানুষের সেবা করে যেতে চাই। গরীব দুখি মানুষের সেবা করার মধ্যে যে আত্মিক শান্তি তা টাকা দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। তাই যতোদিন বেঁচে আছি মানুষের সেবা করে যেতে চাই। যত ব্যস্তই থাকি না কেনো দরিদ্র রোগীদের সেবা আমায় টানে। যতদিন বেঁচে থাকবো পিতা-মাতার ইচ্ছা পূরণে মানব সেবা করে যাবেন বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন এই নারী চিকিৎসক।
জাতি ও মানুষের সেবায় যারা নিজেকে উৎস্বর্গ করেছেন তারই মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকেন অনন্তকাল। কর্মসৃষ্টি বাঁচিয়ে রাখে একজন কৃত্তিমান মানুষকে। কেউ ছোটেন অর্থ বৃত্তের পেছনে আবার কেউ মানব সেবাই নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন। সব পেশায় মানবসেবা করার তেমন সুযোগ থাকে না। তবে ডাক্তারি অনেক বড় মাপের পেশা। সামান্য মাথাব্যথা থেকে শুরু করে যে কোনো অসুখ-বিসুখে মানুষ ডাক্তারের কাছে ছুটে যায়। ডাক্তারের মুখের কথার ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। তাই ডাক্তাররা সমাজের সেবক, মানব সেবক।
সান নিউজ/কেএমএল