ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : কয়েকবার গুলির শব্দ, পরে দেখি মেয়ের রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে আছে মাটিতে। মাথার খুলি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। এমন ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়েছেন পুলিশের গুলিতে আট মাস বয়সী নিহত শিশু সুরাইয়ার বাবা মনোয়ার বাদশা।
আরও পড়ুন : বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ ১১
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ১৯৬৮ সালে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে জমি-জায়গা সর্বত্র হারিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারি থেকে মা, বাবার সঙ্গে ছুটে আসি ঠাকুরগাঁও রানীশংকৈল উপজেলায়। সেই থেকে বাঁচোর ইউনিয়নের মীরডাঙ্গী দীঘি পাহাড় এলাকায় অন্যের জমিতে বসবাস করে আসছি।
মাত্র ৩ বছর বয়সে বাবা মা'র সাথে পাড়ি দিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে আসেন।আজ বড় হয়ে সংসারী হয়েছেন,ধরেছেন অভাবের সংসারে হাল। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন স্বল্পপূজির ব্যবসা তথা ঝালমুড়ি বিক্রয়ের ব্যবসা।
বর্তমানে বৃদ্ধ বাবা আদম আলী (৭০) ৩ বছর ধরে শয্যাশয়ী। পাড়া-মহল্লায় ঝালমুড়ি বিক্রি করে বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী ও তিন সন্তানের পরিবার নিয়ে ভালোই দিন চলছিল।
আরও পড়ুন : ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ একটি গুরুত্বহীন জোট
এদিকে গত ২৭ জুলাই বাদশার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।
সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয় তার ৮ মাসের মেয়ে সন্তান সুরাইয়া আকতার। ঘটনার ১২ দিন পার হলেও সন্তান হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা।
সবচেয়ে ছোট আদরের সন্তানকে হারিয়ে এখনো শোকে পাথর মা মিনারা বেগম। বাবা মনোয়ার বাদশা কিছুটা স্বাভাবিক হলেও মা মিনারা বেগম, দাদি জাহেদা খাতুন (৫৫) কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।
চাপা কান্নায় এখানো দিন কাটছে। আদরের ছোট্ট বোনকে হারিয়ে মুহুর্তেই নিঃসঙ্গ ভাই মিরাজুল ইসলাম (১৩), বড় বোন সুমাইয়া আক্তার (১০)।
ছেলে মিরাজুল ইসলাম মিরডাঙ্গী হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনীতে ও বড় মেয়ে সুমাইয়া আক্তার মীরডাঙ্গী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়াশোনা করছে।
আট মাস বয়সী সুরাইয়া আক্তার সবার ছোট। নন্দুয়ার ইউনিয়নের ভোট কেন্দ্রের দুইশো গজ দূরে তাদের বাড়ি হলেও পরিবারের ভোট বাঁচোর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডে।
আরও পড়ুন : ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৯
নিহত সুরাইয়ার মা মিনারা বেগম জানান, গেল ২৭ জুলাই বিকেলে ভিএফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে শিশু সুরাইয়াকে কোলে নিয়ে তার মা মিনারা বেগম (৩০) ভোট দিতে যান।
ভোট দেওয়া শেষে স্বামী মনোয়ার বাদশার জন্য কেন্দ্র থেকে তিনশো গজ দূরে ফুফু শাশুড়ির বাড়িতে শিশুকন্যাকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
পরে ভোটের ফলাফলকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে তা দেখছে রাস্তায় বের হন। এসময় পুলিশের একটি গাড়ি চলেও যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে করে শিশুকন্যাকে নিয়ে নিজ বাড়ির উদ্দ্যশ্যে বের হলে বাড়ির গেটের সামনে এসে দেখেন ভোটকেন্দ্র থেকে বের হয়ে মসজিদের সামনে রাস্তার ওপর দাঁড়ানো ছিল একটি পুলিশের পিকআপ। তার একটু সামনে পুলিশের আরেকটি গাড়ি দাঁড়ানো।
গাড়ির আশপাশে লাঠি হাতে দাঁড়ানো ছিল বিক্ষুব্ধ সমর্থকরা। ভোটের ফলাফল মানিনা এই দাবিতে একটি গাড়ি থামিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
এ সময় মিনারা তার ৮ মাসের মেয়েকে নিয়ে পাশে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি উঠে যায় সুরাইয়ার । সন্তানের রক্তাক্ত মাথা দেখে মা মিনারা বেগম বে-সামাল হয়ে ছুটোছুটি করেন। এক পর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে জ্ঞান হায়িয়ে পড়ে যান।
আরও পড়ুন : বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ
নিহত সুরাইয়ার বাবা মনোয়ার বাদশা জানান, ভোটের দিন বিকেলে শিশু কন্যাকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী ভিএফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যাই । ভোট শেষে স্ত্রী মিনারাকে বলি আমার দেরি হবে তুমি চলে যাও। তখন সে পাশেই ফুফুর বাড়িতে যায়। তার কিছুক্ষন পরেই ভোট শেষ হয়।
ফলাফলও দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। হুট করে বলা হলো ফলাফল দেওয়া হবে ইউএনও অফিসে। কেন্দ্রে কেন দেওয়া হবে না এই নিয়ে শুরু হয় গন্ডগোল। পরক্ষনেই ঘোষনা করা হয় তালা মার্কা মেম্বার বিজয়ী হয়েছেন। এরপর খালেদুর রহমানের (মোরগমার্কা) লোকজন এসে বললো তালা মার্কা কিভাবে জিতলো? মোরগ জিতেছে।
এই নিয়ে পুলিশ ও এজেন্ট এর সাথে খালেদুর সমর্থকরা হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। পরে পুলিশ কেন্দ্র থেকে ৩০০ গজ দূরে আসলে মোরগ মার্কার সমর্থকেরা রাস্তা ব্যরিকেড দিয়ে পুলিশকে ভোটের ফলাফল নিয়ে যেতে বাধা দেয়।
এ সময় ইউপি সদস্য সমর্থকদের সাথে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। গন্ডগোল দেখে আমি ৪শ গজ দূরে চলে যাই। তারপর পরপর পাঁচবার গুলির শব্দ পাই। এ সময় পুলশ কাদানে গ্যাস ছুড়ে স্থান ত্যাগ করে।
লোকজন বলতে থাকে একজন মারা গেছে। কে মারা গেছে কেউ বলতে পারে না। তখন আমি সামনে গিয়ে দেখি আমার মেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মাথার একটা অংশ নাই। মেয়ের এই অবস্থা দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।এরি মধ্যে ডিসি এসপি সাংবাদিক সহ অনেকে আমার কাছে এসেছে। কাকে কি বলেছি বলতে পারব না।
আরও পড়ুন : চীনাকে প্রতিহতে তাইওয়ানের মহড়া
শুনেছি পুলিশ নাকি ৩টি মামলায় এলাকার ৮শ লোককে আসামী করেছে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। বেশিরভাগ বাড়ি এখন পুরুষশূন্য। অথচ আমার মেয়ে মারা গেল তার মামলা আমি এখনো করতে পারিনি।
প্রশাসনের লোকজন এসে শুধু বিভিন্ন প্রশ্ন করে আর চলে যায়। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে যে পুলিশ সদস্য গুলি করে হত্যা করেছে তার নাম ঠিকানা এখনো জানি না। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কি না তাও জানি না।
এ বিষয়ে রাণীশংকৈল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাহিদ ইকবাল জানান, নির্বাচনী সহিংসতায় অজ্ঞাতনামা ৮০০ জন আসামী করে থানায় পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখনো তদন্ত চলছে।
সান নিউজ/এইচএন