খায়রুল খন্দকার, টাঙ্গাইল; টাঙ্গাইলের বহুল আলোচিত কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের বাসে ডাকাতি ও যাত্রী ধর্ষণের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী রতনের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার কুড়ালিয়া ইউনিয়নের ধলপুর গ্রামে।
আরও পড়ুন: আত্মঘাতী হামলায় ৪ সেনা নিহত
জানা গেছে, ঘটনার পর সেই ডাকাতদলের মূল পরিকল্পনাকারী রতন তার কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ঘটনাস্থল রক্তিপাড়া থেকে পালিয়ে প্রথমে আশ্রয় নেয় তার নানা বেলো মিয়ার বাড়ি মধুপুরে কুড়ালিয়া গ্রামে।
গত বুধবার (৩ আগস্ট) ভোর ৪টার দিকে তার নানার বাড়ির তালাবদ্ধ ঘরের চাবি জোর করে নিয়ে ভিতরে ঢুকেন এবং সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে উক্ত বাড়ির গৃহবধূ জেরিন ৩টি মোবাইলের ব্যাক কভার এবং একটি ছুরি দেখতে পায় বলে আমাদেরকে জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় র্যাব কর্মকর্তার মৃত্যু
ডাকাত দলের মুলহোতা রতনসহ ১০ সদস্য র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর সোমবার (৯ আগস্ট) সরেজমিনে গিয়ে মুল পরিকল্পনাকারী রতনের মধুপুর উপজেলার ধলপুর গ্রামের বাড়িতে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের ঘরবাড়ি তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়।
এলাকাবাসী জানান, প্রায় ১০/১২ বছর আগে রতনের মা বেলী বেগম ধলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পিছনেই ৫ শতাংশ জমি ক্রয় করে তার প্রথম পক্ষের ২ সন্তান আয়নাল ও রতনকে নিয়ে বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন। বাড়ি করার বেশ কিছুদিন পর বেলী বেগম ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা শাকিলকে বিয়ে করেন।
আরও পড়ুন: সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে
এলাকাবাসী জানান, আয়নাল, রতন ও বেলীর ২য় স্বামী শাকিল অনেকদিন যাবৎ ঢাকায় বসবাস করেন। বাড়িতে বেলী বেগম তার ২য় পক্ষের ৫ বছরের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে থাকেন।
প্রতিবেশী বৃদ্ধ মীর আলী জানান, তারা মাঝে মধ্যেই এই বাড়িতে আসা-যাওয়া করেন। লোক মুখে জানতে পারি তারা ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত। ছিনতাই করা মোবাইল এবং নানান জিনিসপত্র এনে তার মা বেলী বেগমের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করতো বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়। এসব বিষয়ে এলাকাবাসী প্রতিবাদ করতে গেলে বেলী বেগম তাদেরকে বিভিন্ন ভয়ভীতি ও মামলায় ফেলার হুমকি দিতো। যে কারণে আশেপাশের কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতো না।
আরও পড়ুন: ফের ইসরায়েলি হামলায় হতাহত ৪২
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাসিন্দা বলেন, ‘বেলীর আগের ঘরের ছেলে রতন ও আয়নালের নামে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের একাধিক মামলা রয়েছে। এর আগেও তারা বিভিন্ন মামলায় কারাভোগ করেছেন।
এ ব্যাপারে কুড়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমি লোক মারফত জানতে পেরেছি, চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষনের ঘটনায় জড়িত প্রধান আসামি রতনের বাড়ি মধুপুরের ধলপুর।
আরও পড়ুন: শিয়ালদহ যাবে দার্জিলিং মেইল
তিনি আরও জানান, বাসে ডাকাতি ও যাত্রী ধর্ষণের ঘটনা খুবই ন্যাক্কারজনক, আমি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
এলাকাবাসী রতনের এই লোমহর্ষক ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। যাতে আর কোন মেয়েকে তার মা বাবার সামনে, কোন স্ত্রীকে তার স্বামীর সামনে এবং কোন ভাইয়ের সামনে তার বোনকে ধর্ষণের শিকার হতে না হয়।
আরও পড়ুন: সরি প্রেমকান্ত, দেশে ফিরে যাও
এ ব্যাপারে মধুপুর থানার পরিদর্শক তদন্ত মো. মুরাদ হোসেন বলেন, ‘রতনের বাড়ি মধুপুরে আমিও শুনেছি। অফিসিয়ালি কোনো বার্তা পাইনি। বিষয়টির তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। তারা যদি প্রয়োজন মনে করেন মধুপুরের বিষয়গুলোও ক্ষতিয়ে দেখবেন।
মধুপুরে চলন্ত বাসে কয়েকটি গণধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে বিশিষ্টজনেরা বলেন, এই সকল অপরাধীরা মধুপুরকে একটি নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে, তারা যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে মধুপুর আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চেকপোস্টের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত দূরপাল্লার বাস তল্লাশির দাবি জানান।
আরও পড়ুন: রেলের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়নি
উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার (২ আগস্ট) সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ার বরাই গ্রাম থেকে ২৪ জন যাত্রী নিয়ে ঈগল পরিবহণের একটি বাসটি যাত্রা শুরু করে। রাত সাড়ে ১১ টার পর সিরাজগঞ্জ রোডে জনতা নামক খাবার হোটেলে যাত্রা বিরতি করে। উক্ত স্থানে ৩০ মিনিটের মতো যাত্রা বিরতি শেষে বাসটি পুনরায় ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। তারপর ভিন্ন ভিন্ন স্থান হইতে অজ্ঞাতনামা ১০/১২ জন ডাকাত যাত্রী বেশে বাসে উঠে এবং পিছনের দিকে খালি সিটে বসে।
বাসটি বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু পার হওয়ার ২০/৩০ মিনিট পরে ৩ আগস্ট রাতে অনুমান সাড়ে দশটায় টাঙ্গাইল সদর থানার নাটিয়াপাড়া এলাকায় রাস্তায় চলন্ত বাসে উক্ত অজ্ঞাতনামা ১০/১২ জন ডাকাত ছুরি, চাকু, কাঁচিসহ আরও দেশীয় অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে বাসের ড্রাইভারকে সিট থেকে উঠিয়ে হাত-পা বেঁধে পিছনে সিটের নিচে ফেলে রাখে এবং ডাকাতরা বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরবর্তীতে উক্ত বাসটিকে গোড়াই হতে ইউর্টান করে এলেঙ্গা হয়ে ময়মনসিংহ রোড ধরে যেতে থাকে। এই সময়ের মধ্যে ডাকাতদল বাসটির জানালার পর্দা ও যাত্রীদের পরনের বিভিন্ন কাপড় ছিড়ে চোখ এবং হাত বেঁধে ফেলে।
আরও পড়ুন: শিয়ালদহ যাবে দার্জিলিং মেইল
পরবর্তীতে ডাকাতরা বাসে থাকা ২৪ জন যাত্রীর নিকট হতে টাকা, মোবাইল, কানের দুল, হাতের বালা, গলার চেইন ইত্যাদিসহ নগদ টাকা ডাকাতি করে নেয় এবং উক্ত বাসে থাকা ১ জন মহিলাকে বাসের মধ্যে ৫/৬ জন ডাকাত সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে। টানা তিন ঘণ্টা যাত্রীদের ওপর চালানো নির্যাতনের পর রাত ৩টা ২৫ মিনিটে মধুপুরের রক্তিপাড়া নামক স্থানে এসে বাসটির গতি কমিয়ে ডাকাত দল নেমে যায়। যাত্রীদের নিয়ে বাসটি রাস্তার পাশের বালুর স্তূপে ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে পড়ে। শব্দ শুনে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে যাত্রীদের উদ্ধার করেন।
এদিকে, র্যাবের হাতে রতন ও তার চক্রের ১০ সদস্য গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে টাঙ্গাইলের ঘটনা ছাড়া আরও তিনটি বাসে যাত্রীকে ধর্ষণের কথাও স্বীকার করেছে রতন।
আরও পড়ুন: দেশের ‘হাওয়া’ বিদেশে
তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, রতনের বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হলো ঝটিকা পরিবহনের গাড়িচালক রাজা মিয়া। ওই পরিবহনের বাসে অন্তত পাঁচবার যাত্রীদের সবকিছু লুট করেছে তার দল। রতন পেশাও বদল করেছে বারবার। কখনও বাসের হেলপার, কখনও পোশাক কারখানায় চাকরি করে। এক সময় ঢাকায় ছোটখাটো ছিনতাইও করত। সেখানে হাত পাকানোর পর মহাসড়ক ঘিরে আরেক ডাকাত গ্রুপ নেতা আয়নালের লোক হিসেবে কাজ করত। সেখানে ৪-৫ বছর কাজ করার পর নিজের নেতৃত্বে ডাকাত দল গঠন করে। রতন এতটাই দুর্ধর্ষ, প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার ডাকাতির ছক কষে। কোনো সপ্তাহে ব্যর্থ হলে পরের সপ্তাহের টার্গেট ঠিক করে। বাসে যাত্রীর সবকিছু লুট করার পর নারীদের টার্গেট করে দলবদ্ধ ধর্ষণের নেতৃত্ব দেয় সে।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা জানান, রতন বিয়েও করেছে একাধিক। প্রথমে ফাঁদে ফেলে চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া এক তরুণীকে বিয়ে করেছিল সে। কিছুদিন পর ওই তরুণী এবং তাঁর পরিবার জানতে পারে- সে পেশাদার ডাকাত। এরপর ভেঙে যায় সেই সংসার। ওই ঘটনার পর আকলিমা খাতুন নামে এক পোশাককর্মীকে বিয়ে করে গাজীপুরে সংসার পাতে। সর্বশেষ নিজ গ্রুপের আরেক ডাকাত সদস্যের স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করছে।
আরও পড়ুন: নারীর চিকিৎসার টাকা উদ্ধার করলেন ওসি
টাঙ্গাইলের ঘটনার দু'দিন আগে সাভারের জিরানী এলাকায় বৈঠক করে রতন। এর এক দিন আগে সে রাজা মিয়াকে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেয়। এরপর মান্না, জীবন, দীপু, আউয়াল ও নুরনবীকে পরিকল্পনার কথা জানায়। রতনের নেতৃত্বে ১৩ জন ডাকাত অংশ নেয় ওই ঘটনায়। ডাকাতির প্রাথমিক খরচ মেটানোর জন্য সে পাঁচ হাজার টাকা লগ্নি করে। ওই টাকা দিয়ে দেশীয় অস্ত্র কেনা হয়। কার কী দায়িত্ব, তা আগে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছক মোতাবেক ২ আগস্ট রাতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মোড়ের একটি দোকান থেকে চারটি চাকু, দুটি ধারালো কাঁচি এবং একটি ক্ষুর সংগ্রহ করে রতন। র্যাবের অভিযানে ১০ ডাকাত গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
রতন হোসেনের বয়স সবে ২১ বছর। পড়াশোনা করেছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ধলপুরের কুরালিয়ায়। এই বয়সেই মহাসড়ক ঘিরে একটি বড় সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল সে। এর মধ্যে দুই দফায় ২০ মাস কারাভোগ করেছে। ৯ মাস আগে জেল থেকে বেরিয়ে ফের ডাকাতি শুরু করে। এ সময়ে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ১০টি ডাকাতিতে অংশ নেয় তার দল। তার মধ্যে চারটি ঘটনায় বাসের মধ্যে ধর্ষণে সরাসরি জড়িত সে।
আরও পড়ুন: কাতার দিল ঘোড়া, বাংলাদেশ দিল হরিণ
তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, রতনের বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হলো ঝটিকা পরিবহনের গাড়িচালক রাজা মিয়া। ওই পরিবহনের বাসে অন্তত পাঁচবার যাত্রীদের সবকিছু লুট করেছে তার দল। রতন পেশাও বদল করেছে বারবার। কখনও বাসের হেলপার, কখনও পোশাক কারখানায় চাকরি করে। এক সময় ঢাকায় ছোটখাটো ছিনতাইও করত। সেখানে হাত পাকানোর পর মহাসড়ক ঘিরে আরেক ডাকাত গ্রুপ নেতা আয়নালের লোক হিসেবে কাজ করত। সেখানে ৪-৫ বছর কাজ করার পর নিজের নেতৃত্বে ডাকাত দল গঠন করে। রতন এতটাই দুর্ধর্ষ, প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার ডাকাতির ছক কষে। কোনো সপ্তাহে ব্যর্থ হলে পরের সপ্তাহের টার্গেট ঠিক করে। বাসে যাত্রীর সবকিছু লুট করার পর নারীদের টার্গেট করে দলবদ্ধ ধর্ষণের নেতৃত্ব দেয় সে।
সান নিউজ/কেএমএল