খায়রুল খন্দকার, টাঙ্গাইল (ভূঞাপুর): টাঙ্গাইল জেলা ভূঞাপুর উপজেলায় বাংলার বহু কীর্তিমান ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। সে সময় থেকেই যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত একটি বাহক ছিলো ঘোড়ার গাড়ি। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি বাহনের সরগরম অস্তিত্ব ছিল। ছিল সর্বত্র এই ঘোড়ার গাড়ির কদর।
আধুনিক যান্ত্রিক যানবাহনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে ঘোড়ার গাড়ি! ইঞ্জিনের স্পর্শে আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক যানবাহনই কালপরিক্রমায় পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের ধারক-বাহক অনেক বাহনেরই আমূল পরিবর্তন, আধুনিকায়ন সাধিত হয়েছে। আবার ঐতিহ্যবাহী অনেক বাহনই হারিয়ে গেছে দৃশ্যপট থেকে।
তেমনি মান্ধাতার আমলে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ঘোড়ার সাহায্যে চলমান ঘোড়ার গাড়ি বহুবিধ কারণে বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে দৃশ্যপট থেকে। কয়েক বছর আগেও কালে ভাদ্রে দু’একটি ঘোড়ার গাড়ির দেখা মিললেও বর্তমানে তা যেন ডুমুরের ফুল।
জানা গেছে, প্রাচীনকাল থেকে গাঁও গ্রামে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হতো ঘোড়ার গাড়ির অবকাঠামো। আর কেটে পুরিয়ে গোলাকার করে পেরেক মেরে তৈরি করা হতো চাকা। ওই গাড়িকে টেনে নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো ঘোড়াকে। কালের আবর্তে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার কমে যেতে থাকলেও এখনও বিশ্বে আধুনিক সকল যানবাহনের জন্য তৈরিকৃত সকল ইঞ্জিনের ক্ষমতাকে ঘোড়ার শক্তি (অশ্বশক্তি) হিসাবে পরিমাপ করা হয়েছে থাকে। যে ইঞ্জিনের অশ্বশক্তি (হর্স পাওয়ার) যত বেশী তার পরিবহন ক্ষমতা ও মূল্যও তত বেশী হয়ে থাকে।
সুপ্রাচীনকাল থেকে দেশের গ্রামীণ জনপদের কাঁচা মেঠো পথে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি ও ঘোড়ার গাড়ির বহুল প্রচলণ পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু যখন থেকে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানী দ্বারা চালিত ইঞ্জিন দিয়ে তৈরি যানবাহনের প্রচলন ঘটতে থাকে তখন থেকেই মান্ধাতা আমলের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরিকৃত ‘ঘোড়ার গাড়ি’র কদর ও ব্যবহার হ্রাস পেতে থাকে।
বর্তমানে দেশের গ্রামীণ জনপদের বেশীরভাগ কাঁচা ও মেঠোপথ/সড়ককে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ওইসব সড়ককে পিচপাথর দিয়ে পাকা সড়কে রূপদান করা হয়েছে। সড়কে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে জায়গা করে নিয়েছে যান্ত্রিক ইঞ্জিন দ্বারা চালিত, সিএনজি অটোরিক্সা, নছিমন, করিমনরা।
নদীমাতৃক এ দেশের চরাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনে দু’একটি ঘোড়ার গাড়ির দেখা মিললেও ক্রমান্বয়ে তাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে প্রাচীনকাল থেকে সড়ক যোগাযোগে বহুল জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ‘ঘোড়ার গাড়ি’ বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে।
ঘোড়ার গাড়ির এই তীব্র দুর্দিনেও প্রাচীনকালের এই বাহনটি চালান জয়ের আলী। তিনি দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেন, আগে আমার বাবা এই ঘোড়ার গাড়ি চালাইতো। তাই আমিও চালাই, কিন্তু আগের মত মালামাল বহন করা হয় না। আমার ঘোড়াটা বিক্রি করতে পারলে অন্যকাজ করতাম। ঘোড়াটা বিক্রি হয় না বলে আমি ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে যা পাই তাই বহন করি সংসার চালাতে হবে তাই।
সত্তর বছরের হাসান শিকদারের সাথে কথা বলে যানা যায়,আধুনিকতার যান্ত্রিক ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঘোড়ার গাড়ি । সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে, গরুরগাড়ি ও গ্রাম বাংলার ঘোড়া দৌড়। এখন আর গ্রাম গঞ্জে চোখে পড়ে না ঘোড়ার গাড়ি।
বিহাড়ী গ্রামের সুরুজ্জামের সাথে কথা হয় ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে। তিনি দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেন, আগে আমার বংশ পরায়নে ছিল ঘোড়া পালন ও ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করা। তারপরও বিভিন্ন জায়গায় ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে অনেক টাকা উপার্জন করত। কিন্তু এখন প্রায় এসব গাড়ি বিলুপ্তির পথে। দু-একটা গ্রামে ১-২টা ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যায় তাছাড়া তো চোঁখেই পড়ে না। এখন আমার বাড়িতে দুই জোড়া ঘোড়া আছে। আমি ও আমার ভাই এই দুই গাড়ি দিয়ে অল্প অল্প করে মালামাল বহন করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করি। যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে এখন গরুর গাড়ি ও ঘোড়ার গাড়ি বিলুপ্তির পথে। বাংলা এবং বাঙালির ঐতিহ্যগুলোকে আমাদের ধরে রাখতে হবে।
গাবসারা দাখিল মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা আব্দুর রউ দৈনিক আনন্দবাজার বলেন, বিয়ে এবং অন্য কোন উৎসবে ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া বিয়েই অসম্পর্ন হয়ে যেত। কিন্তু আধুনিকতার এই যুগে হারিয়ে যাচ্ছে ঘোড়ার গাড়ি। হাতে গোনা দু-একটা গাড়ি দেখা যায় দু-একটা গ্রামে তাও জরাজীর্ন অবস্থা। তাছাড়া যেন চোঁখেই পড়ে না এই গাড়ি গুলো। আজ শহরের ছেলে মেয়েরা তো দুরে থাক গ্রামের ছেলে মেয়েরাও ঘোড়ার গাড়ি ও গরুর গাড়ি যানবাহনের সাথে পরিচিত না খুব একটা। আগে অনেকেরি এই গাড়ি গুলো ছিল উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন।একটা সময় ঘোড়ার গাড়ির চাহিদা ছিল। এখন দেশ উন্নত হয়েছে, ইঞ্জিন চালিত গাড়ির অভাব নেই। তাই আগের মত ঘোড়ার গাড়ির চাহিদা নেই।
সান নিউজ/এনকে