বনিক কুমার, গোপালগঞ্জ থেকে :
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে পানিবন্দি তিন গ্রামের এক হাজারেরও বেশি পরিবার। পানি অপসারণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। অথচ এসব জমিতে এক সময় তিনবার ফসল ফলতো, স্বচ্ছল চাষি পরিবারগুলোর সারা বছরের খোরাক যোগাতো।
তবে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গোহালা ইউনিয়নের গয়লাকান্দি, গঙ্গারামপুর ও খালিয়া গ্রামবাসীর দেড় যুগের সেই দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) পানি নিষ্কাশনের একটি মাত্র উদ্যোগেই। আবারও ফসল ফলিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন তারা।
গয়লাকান্দি গ্রামের কৃষক মো. আবুল হোসেন (৫৫) বলেন, ‘আমাদের এই এলাকায় এক সময়ে তিন ফসল হতো। এখানকার পানি সরকারি খাল গয়লাকান্দি দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মধুমতি নদীতে গিয়ে পড়তো। বিল এলাকায় পানি চলে যাওয়ায় তখন জলাবদ্ধতাও ছিল না, ফসলও ভালো হতো। কিন্তু মাদারীপুর বিলরুট চ্যানেল খননের সময় গোপালগঞ্জ থেকে টেকেরহাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর থেকে আমাদের এই করুণদশার শুরু। আস্তে আস্তে গয়লাকান্দি খালের উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১৫ বছর আগে থেকে আমরা তিন গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হতে থাকি। বর্তমানে এলাকায় বাড়ি-ঘর রাস্তাঘাট, ইটভাটা হওয়ায় কোনোদিকেই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই আমাদের বাড়ির উঠানে, চুলায় পানি জমে যায়। এখন আর ফসলও ফলাতে পারি না, খেয়ে-না খেয়ে কোনোমতে টিকে আছি।’
স্থানীয়দের দাবি ছিল, গয়লাকান্দিতে খালের উৎসমুখে স্লুইচগেট নির্মাণ করলে তারা এই জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবেন। এমন আবেদনের ভিত্তিতেই গয়লাকান্দিতে মাদারীপুর বিলরুট (এমবিআর) চ্যানেলের বেড়িবাঁধের নিচ দিয়ে পানি নিষ্কাশনের কাজ শুরু করেছে বাপাউবো। সম্প্রতি বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম অহেদউদ্দীন চৌধুরী এলাকা পরিদর্শন করে পানি নিস্কাশনে পাইপলাইন স্থাপন কাজের উদ্বোধন করেন। পরে এখানে স্থায়ী স্লুইচগেট নির্মাণ করা হবে বলেও জানান তিনি। পাশাপাশি বেড়িবাঁধের নিচ দিয়ে পানি নিষ্কাশন করে মধুমতি নদীতে পানি বের করে দিতে পদস্থ কর্মকর্তাদের দিক-নির্দেশনা ও জরুরি ভিত্তিতে কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ফরিদপুর অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল হেকিম, গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. শাহিনুর আলম, গোহালা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাফিকুল মোল্লা, ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম মাতুব্বর প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য বলেন, ‘আমরা গোয়ালাকান্দিতে ৮০ ফুট পাইপলাইনের কাজ শুরু করেছি। শেষ হতে আর ১০/ ১৫ দিন সময় লাগতে পারে। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় কাজে একটু বিলম্ব হচ্ছে। পাইপলাইনের কাজ সম্পন্ন হলে আশা করি, ওই এলাকার জলাবদ্ধতা দূর হবে। এখানে স্লুইসগেটও নির্মাণ করা হবে।’
কৃষক মো. আবুল হোসেন (৫৫) এখন বলছেন, ‘সরকার আমাদের আবেদনের ভিত্তিতে পাইপলাইনের কাজ শুরু করেছে। আমরা চাই, গয়লাকান্দি খালের উৎসমুখে স্লুইচগেটটিও দ্রুত নির্মাণ করে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান করা হোক। তাহলেই আমরা আবারও ফসলে ভরিয়ে দিতে পারবো আমাদের জমিগুলো।’
গোহালা ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম মাতুব্বর বলেন, ‘আমার এই ওয়ার্ডের মানুষ দীর্ঘদিন জলাবদ্ধতার সমস্যায় ভুগছি। গয়লাকান্দি খালের উৎসমুখে স্লুইচগেট নির্মাণে আমরা বার বার পানি উন্নয়ন বোর্ডে লিখিত আবেদন করেছি। দেরিতে হলেও গয়লাকান্দিতে পাইপলাইনের কাজ শুরু করছে বোর্ড। এতে সমস্যা কিছুটা যাবে। খালের উৎসমুখে স্লুইচগেটটিও দ্রুত নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি।’
গোপালগঞ্জ জেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. অরবিন্দ কুমার রায় বলেছেন, ‘মুকসুদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে দিয়ে ওই এলাকা পরিদর্শন করিয়েছি। জলাবদ্ধতায় গয়লাকান্দি, গঙ্গারামপুর ও খালিয়া গ্রামের প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাল থাকলেও পার্শ্ববর্তী মাদারীপুর বিলরুট চ্যানেলের বেড়িবাঁধে পানি সরাতে কোনো স্লুইচগেট না থাকায় নদীতে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না এবং পানি প্রবেশও করতে পারছে না। আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি জানিয়েছেন, পানি সরাতে পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলছে। স্লুইচগেট নির্মাণে সময়ের প্রয়োজন। এজন্য প্রকল্প নেওয়া হবে।’
বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম অহেদউদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘এমবিআর চ্যানেলের বেড়িবাঁধের নিচ দিয়ে নদীতে পানি নিষ্কাশনের কাজ শুরু করেছি। এটি শেষ হলে এই এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর হবে। এখানকার চাষযোগ্য জমিতে আবার সঠিকভাবে চাষাবাদ হবে, পানি নিয়ে কৃষকের আর কোনো সমস্যা হবে না।’
তার আশাবাদ, ‘আমরা পশ্চিম গোপালগঞ্জ সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের জন্য ১২০ কোটি টাকা এবং গোপালগঞ্জ জেলার পাঁচটি উপজেলার ভরাট খাল পুনর্খনন, সেচ, পানি নিষ্কাশন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ, পুনর্বাসন, নদীতীর সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য ৯৭২ কোটি টাকার দুটি ডিপিপি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। প্রকল্প দুটির অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হলে পুরো গোপালগঞ্জ জেলায় জলাবদ্ধতার সমস্যা থাকবে না এবং সকল নদী ও খাল আবার সচল হবে।’
সান নিউজ/ এআর