সুমন মিয়া, অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ): সাদা পনিরের জন্য বিখ্যাত কিশোরগঞ্জের হাওরের রানীখ্যাত উপজেলা অষ্টগ্রাম। কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার সুস্বাদু পনিরের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। এটা দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ হয়ে থাকে। দেশের সর্বোচ্চ স্থান বঙ্গভবন-গণভবন থেকে শুরু করে সুদূর ইংল্যান্ড পর্যন্ত প্রশংসা হয় এর স্বাদের।
আরও পড়ুন: জ্বালানি থেকে রাশিয়ার আয় বেড়েছে
অষ্টগ্রামের পনিরের ঐতিহ্য প্রায় সাড়ে তিনশ' বছরের। ১৯৬০ সালে অষ্টগ্রামে প্রায় ঘরে ঘরে পনির তৈরি হতো। কিশোরগঞ্জে পনির এ ইতিহাস অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার সাদা পনিরের সম্ভাবনার কথা অবশ্য উল্লেখ্য যা পুষ্টিগুণে ও স্বাদগুণে দেশ-বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। যথাযথ পরিকল্পনা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে এ পণ্যের আশানুরূপভাবে বিকাশ লাভ করেনি। জেলা ব্র্যান্ডিং এর আওতায় পনিরকে ব্র্যান্ড করা সম্ভব হলে তা এ শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে বেগবান করবে যা দেশের বৃহত্তম অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আনুমানিক প্রায় ৪০০ বছর যাবত পনির উৎপাদন হচ্ছে। সম্ভবত পাঠান মোগল কিংবা দত্ত বংশীয় অভিজাত শ্রেণির মানুষের আগমনের সময় হতে পনির উৎপাদন প্রণালী কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় শুরু হয়। অষ্টগ্রাম সাদা পনিরের জন্য বিখ্যাত। এর খ্যাতি সুদূর ইংল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সম্ভবত পাঠান মোগল কিংবা দত্ত বংশীয় অভিজাত মানুষের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে পনিরের উৎপাদন প্রণালিও এ দেশে আসে।
আরও পড়ুন: পাচারকৃত অর্থ আনার সুযোগ বৈষম্যমূলক
অষ্টগ্রামের হাওর এলাকায় আগে প্রচুর ঘাস হতো এবং ঘাস আবৃত অনেক জমি অনাবাদি থাকত। অষ্টগ্রাম তো বটেই, আশপাশের এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, নরসিংদী প্রভৃতি অঞ্চল থেকে প্রচুর গরু-মহিষের পাল এ লোভনীয় ঘাস আবৃত চারণ ভূমিতে নিয়ে আসা হতো। এই ঘাসের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় 'চাইল্যাঘাস' অত্যন্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ। সে ঘাস দুগ্ধ উৎপাদনের জন্যও খুব সহায়ক। মহিষের এত দুধ হতো, যা বাজারে বিক্রি করে শেষ করা যেত না, ফেলে দিতে হতো। যোগাযোগের ব্যবস্থার অসুবিধার জন্য এই দুধ বাইরে পাঠানো যেত না। দুধের চেয়ে দুধের তৈরি পনির অনেক বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায়।
সম্ভবত এই বিষয়টিও পনির উৎপাদনের জন্য সহায়তা করেছিল।কথিত রয়েছে এ অঞ্চলে যখন দুধের মহাসমারোহ, ঠিক সেই সময়েই শুরু হয় ঈশা খাঁ-মানসিংহের যুদ্ধ। যুদ্ধের একপর্যায়ে মোঘল সেনারা এসে অষ্টগ্রামের কাস্তুলে ছাউনি গড়ে তোলেন এবং পরবর্তীতে অষ্টগ্রামের হাবিলীবাড়ি, ইটনার দেওয়ান বাড়ি, বাজিতপুরের ভাগলপুর এবং করিমগঞ্জের জঙ্গলবাড়িতে মোঘল বংশধরদের বসতি গড়ে ওঠে। অষ্টগ্রামের কাস্তুলের পার্শ্ববর্তী বড় হাওরে ছিল গরু-মহিষের অসংখ্য খামার। ছিল দুধেরও পর্যাপ্ত সরবরাহ। একদিন কাস্তুল ছাউনি থেকে জনৈক মোঘল সদস্য বড়হাওরে গিয়ে দুধের সমারোহ দেখে বেশ উদ্বেলিত হন এবং নিজেও স্থানীয়দের সঙ্গে দুগ্ধজাত খাদ্য তৈরি করতে শুরু করেন। হঠাৎ একদিন তিনি নিজের অজান্তেই কাঁচা দুধের ছানা দিয়ে অত্যন্ত সুস্বাদু পুষ্টিকর খাদ্য তৈরি করে ফেলেন। এরই নাম দেয়া হয় পনির।
আরও পড়ুন: হাসপাতালে ভর্তি খালেদা জিয়া
অনেকের ধারণা, মোঘল বংশীয় জনৈক দেওয়ান পনির খাঁর নামানুসারে এ খাবারটির নামকরণ হয়ে যায় পনির। আর সেই সঙ্গে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে অষ্টগ্রামের পনিরের। দিল্লির মোঘল সম্রাটের শাহী দরবারে সুস্বাদু খাদ্য হিসাবেও অষ্টগ্রামের পনির স্থান করে নেয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান ও বিশ্বের বিভিন্ন রাজপরিবার ও লর্ডদের কাছে অষ্টগ্রামের পনির নাস্তার বিশেষ উপাদান হিসেবে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশর অষ্টগ্রামে হাওর অঞ্চলে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ডেনর্মাক ও নিউজিল্যান্ড থেকে বিশেষজ্ঞ দল এসে পনিরের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে বলেও জানা যায়।
উৎপাদন/ প্রস্তুত প্রক্রিয়া স্থানীয় কারিগর ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পনির তৈরি খুব কঠিন কাজ নয়। একটি বড় গামলায় কাঁচা দুধ সংরক্ষণ করে তাতে 'মেওয়া' নামে একটি পদার্থ মেশালেই দুধ ছানা হয়ে যায়। সেই ছানা বাঁশের তৈরি বাটি আকৃতির পাত্রে লবণ মিশিয়ে জমাট করে রাখতে হয়। শুকিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছানাটি পনিরে পরিণত হয়। এরপরই সেটি বাজারজাত করা হয়। এই পনিরের স্বাদ প্রায় এক হলেও লবণের মাত্রার আধিক্যে কম-বেশি রয়েছে। সাধারণত দুই ধরনের দুধ থেকে বানানো হয় এই পনির। তার মাঝে গরু আর মহিষের দুধ প্রধান।
সান নিউজ/কেএমএল