নিজস্ব প্রতিনিধি:
দেশের উত্তরপ্রান্ত দিয়ে ভারত থেকে ঢোকা নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কিছুটা কমেছে। ফলে বেশিরভাগই বিপৎসীমার নিচে অবস্থান করছে। তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা ও হাওর অঞ্চলের সুরমা নদীর পানি আগের তুলনায় খানিকটা কমেছে। তবে নদী পানিতে টইটুম্বুর হওয়ায় নদীর পাড়গুলোতে দেখা দিয়েছে ভাঙন।
যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব তীর রক্ষা বাঁধে ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৫টি ভিটেবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এদিকে, তিস্তার পানি ওঠানামায় ডিমলার ছয় ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। ইউনিয়নের কিসামত ছাতনাই ও ঝুঁনাগাছ চাঁপানী ইউনিয়নের ছাতুনামা, ভেন্ডাবাড়ী ও ফরেস্টের চড়েরর আশপাশ এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে এলাকার ১০ হাজার পরিবার।
টেপাখড়িবাড়ী ও খালিশাচাঁপানি এলাকার চারটি পরিবারের বসতঘর নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে আপাতত কয়েকদিন নিরাপদ থাকলেও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে আবারও জোরেশোরে বর্ষা নামায় উজানি ঢলের কারণে নদীগুলোতে পানির প্রবাহ বাড়ার আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তাদের আশঙ্কা, আগামী মধ্য জুলাইয়ে শের বন্যা পরিস্থিতির আবারও অবনতি হতে পারে।
এদিকে টাঙ্গাইলে, বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব তীর রক্ষা বাঁধে ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৫টি ভিটেবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শনিবার (৪ জুলাই) রাতে কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ি ইউনিয়নের বেলটিয়া উত্তরপাড়া এলাকায় এই ভাঙন শুরু হয়।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরে সেতু কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব কালিহাতী উপজেলার গোরিলাবাড়ি থেকে বেলটিয়া পর্যন্ত ৪৫৫ মিটার এলাকায় তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে। বাকি অংশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণ করার কথা ছিল। কিন্তু, পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্মাণ করেনি। পরে শনিবার (৪ জুলাই) রাতে বেলটিয়া উত্তরপাড়া এলাকায় তীর রক্ষা বাঁধের শেষ অংশে ভাঙন শুরু হয়। ওই রাতে এ ভাঙনে প্রায় ২৫টি ভিটেবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
অপর দিকে, নীলফামারী ডালিয়া পয়েন্টে শনিবার (৫ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
শুক্রবার (৪ জুলাই) সকাল ৯টায় ওই পয়েন্টে বিপৎসীমার (৫২ দশমিক ৮২) ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ব্যারাজের বিপৎসীমা (৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার)। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
গত ২০জুন উজানের পাহাড়ি ঢলে আর ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আবার ২৬ জুন তিস্তার পানি দ্বিতীয় দফায় বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপর কমলেও তৃতীয় দফায় শুক্রবার (৪ জুলাই) বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হয়। বন্যার পানি সামাল দিতে ব্যারাজের ৪৪ টি স্লুইস গেট খুলে রেখেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
ব্যারাজের গেজ পাঠক (পানি পরিমাপক) নূরুল ইসলাম জানান, গতকাল ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও আজ শনিবার সকাল থেকে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী ইউনিয়নের ১৫ টি চর ও চর গ্রামের বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ওই সব এলাকার বসবাসকারীরা নিরাপদে উঁচু স্থানে সরে গেছে। তিনি জানান, টেপাখড়িবাড়ী ও খালিশাচাঁপানি এলাকার চারটি পরিবারের বসতঘর নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রাণী রায় জানান, ছয় ইউনিয়নের ৩ হাজার ২৪৫ পরিবারকে ১৫ কেজি করে চাল ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়। এরপর তিস্তার ভাঙনে বসতভিটা হারানো ৭৫ পরিবারকে নগদ ২ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি ধীর গতিতে কমতে থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। নদ-নদীর তীরবর্তী চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ঘর বাড়ি থেকে পানি নামতে শুরু করলেও দুর্ভোগ কমেনি বন্যা দুর্গতদের। চলমান করোনা ও বন্যা পরিস্থিতিতে হাতে কাজ না থাকায় খাদ্য সংকটে পড়েছেন বন্যাকবলিতরা। এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতার দিকে তাকিয়ে থাকলেও অপ্রতুল ত্রাণে খাদ্য কষ্টে রয়েছে বানভাসি পরিবারগুলো।
জেলার নদ-নদী অববাহিকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যা কবলিত এলাকায় শিশু ও গবাদি পশুর খাদ্য নিয়েও বিপাকে পড়েছেন বানভাসি মানুষেরা। উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের জাহাজের আলগা গ্রামের আমান আলী, রহমত আলী জানান, নিজেদের পাশাপাশি গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে বানভাসি পরিবারগুলো। অনেকে আসন্ন কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে গরু পালন করলেও বন্যার কারণে পশর কাঙ্ক্ষিত দাম নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বন্যা শুরুর পরপরই জেলার বন্যা কবলিত মানুষের মাঝে সরকারি ৩০২ মেট্রিক টন চাল ও ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকার শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। নতুন করে ২০০ মেট্রিক টন চাল, ২ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যা বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে, ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলা পদ্মা নদীতে শনিবার বন্যার পানি বিপদ সীমার প্রায় ৫০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে উপজেলার চরঝাউকান্দা ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৩শ’ বসত বাড়ি পানিতে ভাসছে বলে জানা গেছে।
বন্যা কবলিত পরিবারগুলো দুয়োরের মাঝ দিয়ে বাশের সাঁকো বানিয়ে নৌকা বা ভেলা দিয়ে যাতায়াত করছে। এছাড়া গ্রামগুলোর অধিকাংশ বসতঘরের মধ্যে বন্যার পানি ঢুকে পড়ার কারণে বাঁশের মাঁচা তৈরি করে বা উঁচু করে চৌকি বসিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে অতি কষ্টে জীবন যাপন করেছে। গৃহস্থ পরিবারের গোয়ালঘরগুলো প্লাবিত হওয়ার ফলে কাঁশবন কেটে এনে গরু রাখার স্থানে ডিবি তৈরি করে চরম ঝুঁকির মধ্যে গবাদি পশুগুলো রাখা হয়েছে।
উপজেলার চরঝাউকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফরহাদ হোসেন মৃধা বন্যা দুর্গতদের খাবার দিতে না পারলেও ব্যক্তি তহবিল থেকে প্রতি বাড়িতে একটি করে সাবান ও কিছু শিশু খাদ্য বিতরণ করছেন।