বিশেষ প্রতিবেদক: কখনো উদ্যোক্তা, কখনো কৃষক, কখনো রাজমিস্ত্রি আবার কখনো কলেজ ছাত্র। নানাভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব জামালপুরের আতিফ আসাদ। সামাজিক কাজের পোস্ট করে প্রায়ই চান বিত্তবানের সহযোগীতা। পেয়েও যান। তার সহযোগীতার নিয়মিত ডোনারও রয়েছে দেশ ও প্রবাসের কয়েকজন। স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে মিশে নিজের সামাজিক কাজ প্রচারে ব্যস্ত থাকতেন আসাদ।
স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের অনুগ্রহে ‘শহীদ মিলন স্মৃতি পাঠাগার’ স্থাপন করে মাত্র ২ বছরের মাথায় বনে গেলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম। এতটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল সবই। কিন্তু কে জানতো এই আসাদই একজন প্রতারক ও মাদক ব্যবসায়ী।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার হাসড়া মাজালিয়া গ্রামের আফজাল হোসেনের ছেলে আসাদ। কখনো কৃষি জমিতে কাজ করেন আবার কখনো রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। কখনো মাটি কেটে সংসার চালান। এসব নিয়মিত ফেসবুকে প্রচার করে মানুষের অনুগ্রহ কুড়াতেন। কলেজে পড়ার পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টির মাঝে সাইকেল চালিয়ে জ্ঞানের আলো বিতরণের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে বাগিয়ে নিয়েছেন কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোক্তা ও সেরা সংগঠক পুরস্কার। নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে নতুন করে সরিসাবাড়িতে শুরু করেছেন স্টিশন পাঠাগার নামে একটি কার্যক্রম।
অনুসন্ধানে স্থানীয়রা জানান, রেললাইনে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে ও নেটওয়ার্ক বাড়াতে ‘স্টিশন পাঠাগার কার্যক্রম’ চালু করে আসাদগং। তার সামাজিক কাজের পিছনে রয়েছে মাদক ব্যবসার প্রসার। সামাজিক কাজের আঁড়ালে আসাদ ও তার পরিবার মাদক ব্যবসার সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। শুধু তাই নয়, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে স্থানীয় চক্রের সাথে দ্বন্দের জের ধরে ২০১৮ সালে খুন হয়েছে তার বড় ভাই মিলন মিয়া। এ সংবাদ স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে সেই সময় প্রচারিত হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিলনের কয়েকজন প্রতিবেশী বলেন, ভাইয়ের খুনের পর মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্য গ্রুপের হাতে। ভাইয়ের খুনের বদলা নিতে নতুন কৌশল অবলম্বন করেন আসাদ ও তার পরিবার। মাদক ব্যবসার দ্বন্দে খুন হওয়া ভাইকে ‘শহীদ’ উপাধী দিয়ে নিজ বাড়িতে পাঠখড়ি দিয়ে গড়ে তোলেন ‘শহীদ মিলন স্মৃতি পাঠাগার’। পাঠাগার স্থাপনের বছর না পার হতেই বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয় স্থানীয় প্রশাসন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধাদের। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের তোপের মুখে মাদক সন্ত্রাসের নামের আগে ‘শহীদ’ শব্দটি বাদ দিয়ে কয়েক মাসের জন্য পাঠাগারের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় আসাদ। কিছুদিন পর ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’ নামে আবার পাঠাগার শুরু করে আসাদ।
স্থানীদের অভিযোগ, প্রত্যন্ত গ্রাম হওয়ায় বই পড়ার নামে মাদকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করাটাই আসাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো। মানুষের অনুদানের চাঁদা দিয়ে পাঠাগার সম্প্রসারিত না করে বাড়ির সামনে গড়ে তোলে রেস্ট হাউজ নামে টিনের ঘর। সেখানে নিয়মিত তাস-জুয়ার আসর বসে এবং গানবাজনার নামে মাদকের আড্ডা হয়। অনুদানের টাকা দিয়ে লড়ছে ভাইয়ের খুন হওয়া মামলা।
গণমাধ্যমে আসাদকে নিয়ে তোড়পাড় দেখে স্থানীয়রা অনেকেই এখন আর মুখ খুলতে নারাজ তার ব্যাপারে। উল্টো সাংবাদিক পরিচয় শুনে আমাদেরকেই প্রশ্ন করে বলে আপনারাইতো তাকে মাথায় তুলছেন। তিলকে তাল বানিয়ে হিরো বানিয়ে দিয়েছেন।
বই পড়ার আড়ালে আসাদের মাদক ব্যবসার নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সরিষাবাড়ি উপজেলা প্রশাসনের দৃষ্টিতে নিয়ে আসেন স্থানীয়রা। বিষয়টি টের পেয়ে আসাদ গতকাল হঠাৎ করে নিজের ফেসবুক একাউন্টে এসে ক্ষমা চেয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্বীকার করেন তিনি ও তার পরিবার যে মাদকের সাথে জড়িত এবং এই মাদকের কারণেই তার বড় ভাইকে খুন হতে হলো।
আসাদ ফেসবুকে লেখেন…
আমার নিজের পরিচয় আপনাদের কাছে গোপন রেখেছিলাম। একটা সময় আমার বড় ভাই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। মেঝ ভাইও জড়িত ছিল। আমিও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলাম। এই তথ্যটি আমার উপজেলার অনেকেই জানেন আবার অনেকেই হয়তো জানেন না।
কিন্তু মানবিকভাবে কেউ বলতে পারবে না, আমরা কারো ক্ষতি বা কিছু করেছি। পারিবারিক অশান্তি বা অনেক প্রেক্ষাপটে মাদকের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি। মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সেসময় আমার বড় ভাইকে হত্যা করা হযয়েছে। আসলে এখানে সামাজিক-রাজনৈতিক অনেক রহস্য ছিল। আমাদের কেউ ভালো পথে আনার চেষ্টা করেনি, শুধু মুখে মুখে বলেছে ভালো হতে।
আমি সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী এত বড় তথ্যটা গোপন রাখার জন্য। আসলেই আমরা ঘৃণিত মানুষ অনেকের কাছে। তবু সেই অন্ধকার সময় থেকে আলোতে এসেছি। সমাজসেবা প্রিয় মনটাকে জড়িয়েছি। আপনারা যদি চান কোন মাদক ব্যবসায়ীর নামে কোন পাঠাগার হতে পারে না, তাহলে আমার সকল কার্যক্রম এখানে বন্ধ করে আমার কর্মজীবনের চলে যাব। আপনারা চাইলে আমি সরে দাঁড়াবো এই সমাজসেবা থেকে কিন্তু পাঠাগারের নাম পরিবর্তন করতে পারবো না।
আসাদের এই স্ট্যাটাসে দুই শতাধিকের অধিক নেতিবাচক মন্তব্য পড়েছে। আসাদের কাছে বেশির ভাগ মন্তব্যকারীই প্রশ্ন করেছে, মাদক ব্যবসায় জড়িত কেউ কিভাবে সমাজসেবক হয়, মানুষকে আলোর পথ দেখায়? অনেকেই লিখেছেন, তথ্য গোপন করে নিজেকে সমাজসেবক বানিয়েছেন, এবার প্রতারণার জন্য শাস্তি হওয়া উচিত। বেশির বাগই পাঠাগারের নাম পরিবর্তনের জন্য আসাদকে অনুরোধ করে লেখেন মাদক ব্যবসায়ীর নামে কোন পাঠাগার হতে পারে না। আলোকিত ব্যক্তিদের নামেই পাঠাগার করুন। অনেকেই প্রতারণার বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
আমাদের প্রতিবেদককে আসাদ বলেন, আমিতো আমার দোষ স্বীকার করে স্ট্যাটাস দিয়েছি ফেসবুকে। তবে পাঠাগারের নাম পরিবর্তনের কোন ইচ্ছে নাই। কেউ সহযোগীতা না করলে প্রয়োজনে পাঠাগার চালাবো না। তবুও নাম পরিবর্তন করবো না।
সরিষাবাড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) উপমা ফারিসা বলেন, এই বিষয়টি নজরে ছিল না, বিষয়টিতে খোঁজ-খবর নিবো। কেউ এখনো এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেনি।
ডোয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন রতন বলেন, সমাজসেবার আঁড়ালে অনেকের অনেক উদ্দেশ্য থাকে। তবে ছেলেটা বহুরূপী আগেই শুনেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বছর দুয়েক আগে একবার ঝামেলা হয়েছে। তারপর কি হয়েছে আর জানি না। মাদক নিয়ে ঝামেলায় তার ভাই মারা গেছে সত্য। বইপড়া সুন্দর জিনিস কিন্তু কোন মাদক কারবীর নামে পাঠাগার হোক এটা আমিও চাই না, জাতিও চায় না। আমি প্রশাসনের সাথে এই বিষয়ে কথা বলবো।
সান নিউজ/এনএএম