নিজস্ব প্রতিনিধি, ঠাকুরগাঁও: গরু কেনার সামর্থ না থাকায় দীর্ঘ ২০ বছর ধরে ঘানি নিজেরা ঘানি টানছেন দরিদ্র খর্গ মোহন সেন দম্পতি। তারপরও ভোক্তাদের নির্ভেজাল সরিষার তেল সরবরাহ করার ব্রত থেকে সরছেন না তারা।
ভাগ্য বদলের আশায় স্বামীর সঙ্গে পূর্ব পুরুষদের এ পেশা রিনা রানী সেন বিয়ের পর বেছে নিলেও অভাব পিছু ছাড়েনি তাঁদের। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ঘানি টানেন। এতে ৪ থেকে ৬ কেজি সরিষা ভাঙতে পারেন।
সাধারণত কলুরা গরুর চোঁখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়ে ঘানিগাছে সরিষা দিয়ে তেল বের করেন। তবে দরিদ্র খর্গ মোহন সেনের গরু কেনার সামর্থ্য নেই। অভাবের সংসারে এক দিন ঘানি না ঘোরালে চলে না। আর অভাব যখন ঘরের দরজায় উঁকি দেয়, চারদিক তখন অন্ধকার হয়ে আসে পরিবারটির।
ঠাকুরগাঁও জেলার মানুষ এক সময় খাঁটি সরিষার তেলের উপর নির্ভরশীল ছিল। তখনকার দিনে সরিষার তেল ছাড়া অন্য তেল ব্যবহার করত না মানুষ। এ কারণে গ্রাম এলাকায় সচল ছিল ঘানিগাছ। পরবর্তীতে সোয়াবিন ও পাম তেল সহজলভ্য ও দামে কম হওয়ায় মানুষ সরিষার তেল থেকে দূরে সরে আসে। তারপরও মানুষের চাহিদার কারণে এখনও কোন কোন এলাকায় সচল আছে ঘানিগাছ।
ঠাকুরগাও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের গুয়াবাড়ি কিসামত গ্রামে এক সময় বাড়ি বাড়ি তেলের ঘানি ছিল। ওই তেল বিক্রি করেই তাদের সংসার চলতো। কালের বিবর্তনে মেশিনে ভাংগা তেলের দাম কম হওয়ায় ওই গ্রামের বেশির ভাগ কলু বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যায়। তবে খর্গ মোহন সেন ও তার সহধর্মিণী রিনা রানী সেন এখনও ধরে রেখেছেন পৈত্রিক এ পেশা।
খর্গ মোহন সেনের বয়স এখন ৬০ বছর আর স্ত্রী রিনা রানী সেনের বয়স ৫৫ বছর। এক সময় তাঁরা গরু দিয়ে ঘানি টেনে ৬ থেকে ৭ কেজি তেল উৎপাদন করতে পারতেন। কিন্তু গরু না থাকায় দীর্ঘ ২০ বছর ধরে গরুর বদলে নিজেরা কাঁধে জোয়াল তুলে নেন।
এভাবে ঘানি ভাঙ্গা তেল বিক্রি করে ৩ ছেলে ও ২ মেয়ের সংসার চালাচ্ছেন খর্গ মোহন। কিন্তু বয়সের কারণে আগের মতো শরীরের শক্তি নেই। তাই ঘানি টানতে পারেন না। এখন অসুস্থ এই দম্পতি ঘানি টেনে ১ থেকে ২ কেজি তেল উৎপাদন করতে পারেন।
সেই তেল বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার চালিয়ে আসছেন তারা। বর্তমানে প্রতি কেজি সরিষার তেল ২০০ টাকা। এবং মেশিনের তেল ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর খৈল বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি দরে।
গ্রামের অশেষ রায় বলেন, এক সময় এ গ্রামে অনেক ঘানিগাছ ছিল। বর্তমানে সারা গ্রামে একটি বাড়িতে ঘানি রয়েছে। কিন্তু গরু না থাকায় নিজেরা ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে স্বামী-স্ত্রী ঘানি টানছেন।
রিনা রানী সেন জানান, অভাবের সংসারে গরু কেনার মত সামর্থ নেই। তাই নিজেরা গাছ টানি। মাঝে মধ্যে আমার বড় ছেলে ঘানি টেনে সহযোগিতা করে বলেও জানান তিনি।
খর্গ মোহন সেন বলেন, বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখতে গানি টানতে টানতে অন্য কোনো পেশা শিখতে পারিনি। আগে নিজরা কলুর বলদের কাজ করতাম। এখন আর শরীর চলে না। তাই কোন মতে ঘানি টেনে যেটুকু তেল হয়, তা বিক্রি করে সংসার চালাই।
তিনি আরো বলেন, কেউ যদি একটা গরু কিনে দিত তাহলে বাকি জীবন আর কষ্ট করতে হতো না।
সান নিউজ/এমকেএইচ