নিজস্ব প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০২১ উপলক্ষ্যে নাগরিক উদ্যোগ ও আইপিনিউজের যৌথ উদ্যোগে ‘আদিবাসীদের ভূমি সুরক্ষা ও করণীয় শীর্ষক’ এক অনলাইন আলোচনা সভা আজ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় আলোচনায় যুক্ত ছিলেন সাংসদ ফজলে হাসান বাদশা এমপি, সাংসদ আদিবা আনজুম মিতা এমপি, বেলা’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, সিডিএ’র নির্বাহী পরিচালক শাহ- ই -মবিন জিন্নাহ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অনুরাগ চাকমা।
এছাড়া অনুষ্ঠানে ধারণা পত্র উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সদস্য সোহেল হাজং এবং পটুয়াখালী থেকে যুক্ত থেকে পটুয়াখালী ও কুয়াকাটা অঞ্চলের রাখাইন আদিবাসীদের সামগ্রীক অবস্থা তুলে ধরেন মং ম্য উইন।
প্রারম্বিক আলোচনায় সোহেল চন্দ্র হাজং বলেন, ‘আদিবাসী’ ও ‘ভূমি’ শব্দ দু’টি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। একটি ছাড়া অন্যটির কথা চিন্তা করা যায় না। আদিবাসীদেরকে কেউ কেউ ভূমির প্রকৃত সন্তান বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন।
কেননা, ভূমিকে রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি আদিবাসীরাই এতোদিন করে আসছেন। ভূমিকে তারা কেনাবেচার পণ্য হিসেবে যেমন ভাবতে পারে না, আবার ভূমিকে নিজের কর্তৃত্বে বা মালিকানায় নেওয়ার কথা অতীতে কখনো তারা চিন্তাও করেনি।
কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে, ভূমিকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের প্রতি যতো জুলুম, উচ্ছেদ, জবরদখল, কেনাবেচা, হত্যা, নির্যাতন, মিথ্যে মামলা, অপরাধীকরণ ইত্যাদি ঘটনা ঘটেই চলেছে। এখন ভূমি সমস্যাই আদিবাসীদের অন্যতম প্রধান সমস্যা। আদিবাসীদের ভ‚মি অধিকারের স্বীকৃতি না থাকার ফলে আদিবাসীরা ভূমিহীন ও দেশান্তরি হয়ে পড়ছে বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলে সমানতালে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা প্রভাবশালীদের দ্বারা কখনো ন্যাশনাল পার্ক, ইকো-পার্ক, নিরাপত্তা ক্যাম্প, ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নামে স্থানীয় আদিবাসীদের কোন স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ব্যতিরেকে, জোর জবরদস্তি করে তাদের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। আদিবাসী অধিকার বিষয়ক সরকারের নানা প্রতিশ্রতি থাকলেও তার কোনো বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।
সমতলে সরকারের প্রতিশ্রতি থাকা সত্বেও এখনও আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না আবার পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি কমিশন গঠিত হলেও এর কার্যক্রম অনেকটা থেমে আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বান্দরবানে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ এবং জনগোষ্ঠীর বাস্তুচ্যুতিসহ করোনাকালে এইসব ভূমি দখলের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনকে অকার্যকর অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করার কথা থাকলে এখনো গঠন করা হয়নি। সমতলের আদিবাসীদের জন্য মন্ত্রণালয় না থাকায় তারা সরকারের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারছেন না।
মানবাধিকার কমিশন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের কাছে আদিবাসীদের ভূমি রক্ষা রিপোর্ট জমা দিবে এবং আমরা ও সেটা পার্লামেন্টে নিয়ে যাব। সেপ্টেম্বরে পার্লামেন্ট বসলে সেখানে আদিবাসী অধিকার আইনের প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হবে। অধিকার আদায়ে আন্দোলন সংগ্রামের বিকল্প নেই।
সাংসদ আদিবা আনজুম মিতা বলেন, আদিবাসীরা সবসময় সহজ সরল। আমার তাদের ভালো লাগে।একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে আমরা যেহেতু আমরা বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করি আমরা চেষ্টা করবো আদিবাসীরা যেন তাঁদের ভূমি রক্ষা করতে পারে এবং অস্থিত রক্ষা করতে পারে। আদিবাসীদের ভূমি সুরক্ষা আইন প্রনয়ণে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করব। তবে আইনে যেন ভুল-ত্রুটি না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য আহবানও জানান এই সাংসদ।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, বাংলাদেশের সরকারগুলো স্বীকার করেছে প্রচলিত ভূমি আইনে অনেক সমস্যা। এই প্রচলিত ভূমি রক্ষা আইনে আদিবাসী ও বাঙ্গালির ভূমি বেদখল বন্ধ করতে পারবেনা এটা প্রমাণিত। সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে আলাদা করে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন হয়েছে।
সমতলে ১৩ বছর আগে থেকে প্রতিশ্রতি চলমান রয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার ব্যপারে এথনিক রিলিজিয়াস এন্ড ল্যাঙ্গুয়েস্টিক মাইনরিটি থিমেটিক গ্রপ নামে একটি কমিটি গঠন করেছেন যারা আগামী ৩ মাসের মধ্যে আদিবাসীদের ভূমি রক্ষায় কি কি করা দরকার তা নিয়ে একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিবে বলেও জানান এই আদিবাসী নেতা।
বেলা’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজোয়ান হাসান বলেন, আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। বান্দরবানে ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে দাড়াতে সিকদার গ্রপ নাকি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভীত করছে তা খুঁজে বের করতে হবে। মধুপুরের শালবন রক্ষায় কোর্টে মামলা করলেও কোর্ট বলছে গেজেট বাতিল হবে না।ভূমি ও বনাঞ্চল রক্ষায় "ফরেস্ট রাইট এ্যাক্ট" প্রণয়নের কথা আমাদেরকে ভাবতে হবে।
তিনি আরো বলেন, সরকার আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করে না এবং যারা ব্যবহার করে তাদেরকে শব্দটি ব্যবহারে নিষেধ করেছে। এজন্য সরকার এনজিও সমূহকে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করতে চিঠি দিয়েছে।কাজেই ভূমি, পরিবেশ এসব বিষয়ে আলোচনার করে আমরা এগোতে পারবো না। সমস্ত বিষয় নিয়ে আমাদের একটি ‘পলিটিক্যাল ডিবেট’ প্রয়োজন। আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে বলেও মনে করেন এই পরিবেশ আইনজীবি।
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, উপস্থাপিত ধারণা পত্রের সাথে একমত পোষণ করেন। আদিবাসীদের প্রতি যে ঐতিহাসিক অবিচার; বঞ্চনা ও বৈষম্য তা বিলোপ হওয়া দরকার। তার জন্য আমরা লড়াই করছি। পাহাড়-সমতলের আদিবাসীদের নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার, ভূমি অধিকার রক্ষা করার জন্য নাগরিক অধিকার কমিটি গড়ে তোলা। এর জন্য আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অনুরাগ চাকমা বলেন, আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের সুরক্ষার বিষয়টি ‘মাল্টিভ্যারিয়েট’ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে।
যেহেতু আদিবাসীদের ভূমি সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমজাতীয় নয় সেহেতু একটি নির্দিষ্ট কৌশল দিয়ে অগ্রসর হলে সেটা কতটুকু ফলপ্রসু হবে তা প্রশ্ন থেকে যায়। একজন প্রতিবেশী কর্তৃক ভূমি বেদখল করা আর প্রশাসনের নিরব ভূমিকার কারণে একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভূমি বেদখল করা এক জিনিস নয়। আবার উন্নয়নের নামে আগ্রাসন করা এবং আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা এক জিনিস নয় বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
একজন প্রতিবেশীর সাথে আইনি লড়াই করা এবং একটি শক্তিশালী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সাথে একজন আদিবাসীর আইনি লড়াই করা এক জিনিস নয়। এক্ষেত্রে আমাদেরকে ক্ষমতা কাঠামো বুঝতে হবে। যার জন্য যারা ভিক্টিম এবং যারা উচ্ছেদের শিকার তাদেরকে রাষ্ট্রকর্তৃক আইনগত সহায়তা প্রদানের দিকটি ভেবে দেখা উচিত।
সিডিএ’র নির্বাহী পরিচালক শাহ- ই -মবিন জিন্নাহ বলেন, আমারা প্রতিবছর আদিবাসী দিবস আসলে নানান আলোচনা করি এবং দাবী তুলি। এভাবে একটু একটু করে অগ্রসর হচ্ছি। আদিবাসীদের ‘ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী’ বলার বিষয়ে আমাদেরকে আগে সমাধানে আসতে হবে। কেন তাদেরকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা হবে। যে করেই হোক সকল ক্ষেত্রে আদিবাসী পরিচয়টি প্রতিষ্ঠা করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
সাননিউজ/এএসএম