নিজস্ব প্রতিনিধি, পঞ্চগড়: পঞ্চগড় জেলায় মৌখিক তিন তালাকের জেরে এক দম্পতিকে দুই মাস ধরে একঘরে করে রেখেছেন সমাজপতিরা। নির্মম ও চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদীঘি ইউনিয়নের ছলিমনগর গ্রামে।
এলাকাসূত্রে জানা গেছে, ছলিমনগর এলাকায় আয়নাল হক ও জমিরন বেগম প্রায় ৩০ বছর ধরে সংসার করে আসছেন। তাঁদের সংসারে চার সন্তান আছে। দরিদ্র ওই পরিবারের টানাটানির সংসারে দুই মাস আগে হঠাৎ করে স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়। পরে একপর্যায়ে রাগের বসে তাঁরা একে অপরকে তিন তালাক দিয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হলে ছলিমনগর জামে মসজিদের সভাপতি নাছির উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম, শাহজান আলী, ইমান আলী, হাফেজ মোস্তফা কামাল, জুলহাস, সুরমান মেম্বার, আমির চাঁদ, আব্দুর রশিদ, দেলোয়ার হোসেনসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন সমাজপতি বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে তাঁরা পার্শ্ববর্তী এলাকার মাওনালা মুফতি আনোয়ার হোসাইন ও হাফেজ মোস্তফা কামাল নামে দুজন আলেমকে নিয়ে এলে তাঁরা দুজন জমিরন বেগমকে হিল্লা বিয়ে দেওয়ার পর আবার বিয়ে করে সংসার করার ফতোয়া দেন। তা না হলে আয়নাল ও জমিরন একসঙ্গে সংসার ও বসবাস করতে পারবেন না বলে জানান তাঁরা। আর এই নিয়ম না মানলে সমাজচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয় আয়নাল হক ও জমিরন বেগমকে।
এদিকে স্বামী আয়নাল ও স্ত্রী জমিরন উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলে তাঁরা সমাজপতিদের সিদ্ধান্ত না মেনে দিনাজপুর খানসামা উপজেলায় জনৈক মাওলানার বাড়ি গিয়ে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। পরে সমাজপতিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ছলিমনগর জামে মসজিদ সমাজের সব সদস্যকে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা, বাড়িতে যাতায়াত, কোনো জিনিসপত্র আদান-প্রদান, হাটবাজারসহ সবকিছুতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। বর্তমানে ওই দম্পতি সমাজের কারও সঙ্গে চলতে–ফিরতে পারছেন না। গ্রামের কোনো দোকান ওই দম্পতির কাছে কোনো পণ্য বিক্রি করছেন না, তাঁদের কোথাও কোনো কাজেও নেওয়া হচ্ছে না। সমাজপতিদের চাপে দীর্ঘ দুই মাস ধরে তাঁরা একঘরে অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সমাজপতিরা ওই দম্পতির ভাই, ছেলে, পরিবারের অন্য সদস্য এবং আত্মীয়স্বজনকেও তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। যোগাযোগ করা হলে তাঁদেরও একঘরে করা হবে এবং ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজপতিরা স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত করায় ভুক্তভোগী জমিরন নেছা গত সোমবার দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রত্যয় হাসানের বরাবর ১০ সমাজপতির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য লক্ষণ চন্দ্র রায় জানান, আয়নাল ও জমিরন নেছা দম্পতির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঝগড়া_বিবাদ হয়ে আসছিল। দুই মাস আগে তাঁরা নিজেরা ঝগড়া করে একে অপরকে তালাক দিয়েছিলেন বলে আমি শুনেছি তাঁদের একঘরে করে রাখা হয়েছে। আমি স্থানীয় কয়েকজন সমাজপতির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বসেছিলাম, কিন্তু ইসলামি আইনকানুনের কথা বলে তাঁরা হিল্লা বিয়ে দিতে ইচ্ছুক। আমার কথা তাঁরা না শোনায় পরে আমি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। পরে শুনেছি আয়নাল হক তাঁর বাসায় এবং তাঁর স্ত্রী জমিরন ছেলে ওমর ফারুকের বাসায় বসবাস করছেন।
এ বিষয়ে ছলিমনগর জামে মসজিদের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম জানান, স্থানীয় সমাজের বৈঠকে লোকজনের উপস্থিততে মুফতি আনোয়ার হোসাইন ও হাফেজ মোস্তফা কামাল আয়নাল ও তাঁর স্ত্রী জমিরনকে সমাজ থেকে বয়কট এবং সমাজের লোকজনের সঙ্গে চলাচলে নিষেধাজ্ঞার ফতোয়া দেন ৷ মুফতি আনোয়ার হোসাইন ও হাফেজ মোস্তফা কামাল বলেছেন যে জমিরন মুখ দিয়ে বাইন তালাকের কথা বলায় তালাক হয়ে গেছে। জমিরনকে হিল্লা বিয়ে দিতে হবে। এর আগে তাঁর চেহারা দেখা যাবে না। তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে। সমাজচ্যুত করতে হবে। সমাজের কোনো লোকজন তাঁদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে পারবে না।
এ বিষয়ে আয়নাল হক ও জমিরন বেগমের বড় ছেলে ওমর ফারুক বলেন, `আমার বাবা-মায়ের তালাকের বিষয়টি নিয়ে মসজিদে সমাজপতিরা একাধিকবার বৈঠক করেছেন ৷ সর্বশেষ বৈঠকে সমাজপতিরা বাবা–মাকে আলাদা করে দিয়েছেন সমাজ থেকে। আমাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেন না তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আমাদেরও একঘরে করে রাখা হবে এবং ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু আমার মা–বাবা তাঁদের নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে মাওলানার কাছে গিয়ে আবার বিয়ে করেন। তার পরও সমাজপতিরা আমাদের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছেন। তারা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা দিচ্ছেন।'
এদিকে লিখিত অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. প্রত্যয় হাসান বলেন, `স্থানীয়ভাবে উভয় পক্ষের সঙ্গে বসে মীমাংসার জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে বিষয়টি নিয়ে ছলিমনগর গ্রামে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। আমি নিজেও সেখানে উপস্থিত থাকব।
সাননিউজ/ জেআই