নিজস্ব প্রতিনিধি, ফরিদপুর : পাটের জাগ হারানোকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছে। শুক্রবার (২৩ জুলাই) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দফায় দফায় উপজেলার পরমেশ্বরদী খাল-কাজীপাড়া এলাকায় এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এতে উভয়পক্ষের ২০/২৫ টি বাড়িঘর-দোকান ভাঙচুর করা হয়। সংঘর্ষে ছয়জন পুলিশসহ উভয়পক্ষের অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। পুলিশ সদস্যরা বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। উভয়পক্ষের আহতদের অনেকে বিভিন্ন মামলার আসামি হওয়ায় তারা বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিয়ে পলাতক রয়েছেন।
এদিকে খবর পেয়ে বোয়ালমারী ও সালথা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় উভয়পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ শটগানের গুলি চালায় এবং লাঠিচার্জ করে।
জানা গেছে, এক সপ্তাহ আগে উপজেলার পরমেশ্বরদী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি মাসুদ শেখের সমর্থক মনিরুল ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ-বিষয়ক সম্পাদক আ. মান্নান মাতুব্বরের সমর্থক নজরুল মোল্যা স্থানীয় কুমার নদীতে পাশাপাশি পাট পঁচানোর জন্য জাগ দেয়। কয়েক দিন পরে মনিরুলের পাটের জাগ হারিয়ে গেলে তিনি নজরুল মোল্যার বাড়ি গিয়ে পাটের জাগের ব্যাপারে জানতে চান। এ সময় নজরুল মনিরুলকে বলেন, আমার পাট উঠিয়ে নিয়ে এসেছে; তোমারটা কোথায় গেছে তা জানি না। ওই সময় উভয়ের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়।
এই ঘটনা ও কোরবানির মাংস কীভাবে ভাগাভাগি হবে এ নিয়ে ময়েনদিয়া ও পরশ্বেরদী গ্রামে ঈদের আগের দিন দুই গ্রুপের মধ্যে বিভিন্ন সময় গোপনে মিটিং চলছিল। এই ঘটনার জের ধরে শুক্রবার সাড়ে ৯টার দিকে দুই গ্রুপের লোকজন দেশীয় অস্ত্র ঢাল, সড়কি, রামদা ও লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের সময় পাশের সালথা উপজেলার খারদিয়া গ্রামের কিছু লোকজন মাসুদের লোকজনের পক্ষে যোগ দেয়।
পরমেশ্বরদী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি মো. মাসুদ শেখ বলেন, ‘আমি ঢাকায় অবস্থান করছি। ঈদেও বাড়ি যায়নি। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নুরুল আলম মিনা মুকুল আওয়ামী লীগ থেকে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তাই তার সঙ্গে রাজনীতি করি। তবে মান্নান মাতুব্বর বিভিন্ন সময় আমাকে ও আমার লোকজনকে হুমকি দিয়ে বলেন, ময়েনদিয়া বাজারে ব্যবসা করতে হলে আমার সঙ্গে রাজনীতি করতে হবে। শুনেছি ময়েনদিয়া বাজারে আমার দোকান ও আমার পক্ষের লোকজনের বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে মান্নান মাতুব্বর গং।’
আরেক পক্ষের নেতৃত্বদানকারী পরমেশ্বরদী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ-বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল মান্নান মাতুব্বর বলেন, ‘আমি স্থানীয় রাজনীতি করি। আমার লোকজনকে দলে নিতে মাসুদ বিভিন্ন সময় ভয়ভীতি দেখায়। আজকে তার লোকজন আমার পক্ষের লোকজনের ওপর হামলা চালালে আমার লোকজনও তাদের ওপর পাল্টা হামলা চালিয়েছে। আমার দুইজন মারাত্মক আহত হয়ে ফরিদপুর মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে।’
এ ব্যাপারে পরমেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নুরুল আলম মিনা মুকুল মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার কোনো গ্রুপ নাই। সবাই এ ইউনিয়নের বাসিন্দা। মান্নান মাতুব্বর গ্রুপ ও মাসুদ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আগের একটি সংঘর্ষের ঘটনায় আমাকে প্রধান আসামি করা হয়। সংঘর্ষের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
এ ব্যাপারে বোয়ালমারী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, সংঘর্ষের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সংঘর্ষে লিপ্তদেরকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য শটগানের গুলি নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করা হয়। সংঘর্ষের এলাকা বর্তমানে শান্ত রয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেনি।
এদিকে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়ে মারা গেছেন শহীদ ফকির (৪৭) নামে এক ব্যক্তি। শুক্রবার সন্ধ্যায় ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালিত ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। শহীদ ফকির পরমেশ্বরদী ইউনিয়নের ফকির পাড়া গ্রামের রাজ্জাক ফকিরের ছেলে। পেশায় তিনি একজন কৃষক। তিনি বিবাহিত এবং দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক।
শহীদ ফকিরের খালাতো ভাই মান্নান ফকির বলেন, গতকাল সকালে পরমেশ্বরদী ইউনিয়নের কাটা খাল এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে প্রতিপক্ষের রামদায়ের কোপে মারাত্মকভাবে আহত হন শহীদ। তাকে দ্রুত ফরিদপুর ট্রমা সেন্টারে এনে ভর্তি করা হয়। এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মারা যান তিনি।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের অর্থপেডিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনাদি রঞ্জন মন্ডল বলেন, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শহীদ ফকিরের পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। এছাড়া তার পেটেও ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা নেয়ার প্রস্তুতির আগেই তিনি ফরিদপুর ট্রমা সেন্টারে মারা যান।
সাননিউজ/এমএইচ