নিজস্ব প্রতিনিধি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাবার সাথে চার দোকানে কাজ করতেন ছেলেবেলায়। সেই চা দোকানের উত্তাপে তিনি রাজনীতির মাঠও গরম করে রাখছেন। বাংলাদেশে তেমনি একজন ব্যক্তি চাঁপাইনবাবগঞ্জের চায়ের দোকানদার সারোয়ার জাহান সাঞ্জু। সরাসরি চায়ের দোকান থেকে এখন তিনি প্রভাষক পদে নিয়োগ পেতে চলেছেন। কাজকে যারা ছোট করে না দেখে তাদের জন্য এ দু’জন আদর্শ হতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) বাংলাদেশে বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের ফল প্রকাশ করে। ওই ফলাফল অনুযায়ী সারোয়ার জাহান সাঞ্জু বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সৈয়দ আহম্মদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বারোঘরিয়া বাজারে চায়ের দোকান করেছেন সারোয়ার জাহান সাঞ্জুর বাবা মো. শাহজাহান আলী। জন্ম থেকেই দরিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে সারোয়ারকে। ৪ ভাই বোনের মধ্যে সারোয়ার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। বারোঘরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ২০০১ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন তিনি। এরপর চামাগ্রাম হেনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। এতে নিজ বিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম ছাত্র হিসেবে জিপিএ-৫ পান তিনি।
২০০৮ সালে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্ব দেখান সারোয়ার। এইচএসসি পাশের পর দেশের সেরা ও র্যাংকিংয়ের এক নম্বর রাজশাহী সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করেন মেধাবী সারোয়ার।
সারোয়ার জাহান সাঞ্জু বলেন, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি বাবাকে চায়ের দোকানে সহযোগিতা করে আসছেন তিনি। লেখাপড়া শেষ করে দিনের পুরো সময় বাবার চায়ের দোকানে কাজ শুরু করছেন। চা বানিয়ে নিজেই পরিবেশন করছেন। এমনকি এখন চায়ের দোকানে কাজের পাশাপাশি তিনি টিউশনিও করেন। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন। তবে সেই প্রস্তুতিটাও চায়ের দোকানেই। বাড়িতে উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় দোকান বন্ধ করে দেওয়ার পর দোকানেই শুরু করেন চাকরির জন্য পড়াশোনা। প্রতিদিন দুপুর ও রাতে পড়া শেষ করেই ফেরেন বাড়ি। এভাবেই এনটিআরসিএ কর্তৃক শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হয়েছেন চা দোকানি সারোয়ার।
তিনি আরও বলেন, আমার জীবনে কষ্টের অভাব ছিল না। চারদিকে ছিল শুধুই অন্ধকার। ছোটবেলায় ভালোভাবে খেতে পাইনি। নোংরা জামা-কাপড় পড়ে ঘুরে বেরিয়েছি, তবুও কখনও নিজের পড়াশোনা বাদ দেয়নি। বারোঘরিয়া বাজারে সরকারি জায়গায় একটি চালা দেওয়া বাবার চায়ের দোকান। ২০০১ সালে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকেই চায়ের দোকানে বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতে থাকি। স্কুল-কলেজে যাওয়া বাদে বাকি সময় কাটতো চায়ের দোকানে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলে চায়ের দোকান চালানোর কাজ।
তিনি বলেন, এইচএসসি পাশের পর রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলেও সেখানে থেকে ক্লাস করা হয়নি। কারণ চায়ের দোকান চালাতে হবে। তাই ফজরের সময় বেরিয়ে রাজশাহীতে ক্লাস শেষে বিকেল ৩টার মধ্যে বাড়িতে ফিরতে হতো। চায়ের দোকানের পাশাপাশি চলতে থাকে টিউশনি। ২০১৬ সালে মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর পুরো সময় চায়ের দোকানে কাজ করি। ফজরের সময় দোকান খুলে ১০টা পর্যন্ত যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে চাল-ডাল-তরকারি কিনে বাবা বাসায় চলে যান। কারণ হৃদরোগের কারণে মা অসুস্থ থাকায় বাবা রান্না করেন।
সারোয়ার জাহান সাঞ্জু জানান, নিয়োগপ্রাপ্তির খবরে আমার থেকে বাবা-মা আরও বেশি খুশি হয়েছেন। আল্লাহর অশেষ কৃপায় জায়নামাজে থাকা অবস্থায় মাকে এই খুশির খবরটি দিতে পেরেছি। সেদিন বাবার মোবাইলে যতগুলো ফোন নম্বর ছিল সবাইকে তিনি খুশির খবরটি রাত ২টা পর্যন্ত ফোন করে বলছিলেন। তবে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগেই আটকে থাকতে চান না তিনি। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াই এখন তার প্রধান লক্ষ্য বলে জানান সারোয়ার।
সান নিউজ/এফএআর