আব্দুল্লাহ হেল বাকী, নওগাঁ: ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ভরা সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁ। এই নওগাঁয় অবস্থিত জাতীয় উদ্যান আলতাদীঘি। জেলা শহর থেকে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার উত্তর ভারতীয় সীমান্তের কোল ঘেঁষে। এই আলতাদীঘির শেষ সীমান্তে অবস্থিত আন্তর্জাতিক সীমারেখা।
অপরদিকে পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট জেলা শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার পশ্চিমে নির্জন বনের গভীরে জাতীয় উদ্যান আলতাদীঘি। উদ্যানের নিরিবিলি, নির্জন, প্রচুর গাছপালা, সর্পিল পথ, গহিন বন অজানা এক পরিবেশে গা-ছমছম করে উঠবে। বিশেষ করে শালগাছকে আলিঙ্গন করে গড়ে ওঠা উঁই পোকার ঢিবিগুলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। মাঝে মধ্যে চেনা-অচেনা পাখির আচমকা ডাক, শালপাতার ফাঁকে ফাঁকে আলো ছায়ার লুকোচুরি আর বাতাসের দোলায় মন মাতাল হওয়ার জোগাড় হবে।
জেলার সর্ববৃহৎ ও সুপ্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ এই দীঘির বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় বিষয় পদ্মফুল। স্বচ্ছ পানিতে ফুটে ওঠা হাজারো পদ্মফুল যেকোনো ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে করছে বিমোহিত। শীতকালে পরিযায়ী পাখি, ডাহুক, পানকৌড়ির ওড়াউড়িতে মুগ্ধকর সব দৃশ্য যেকোনো বয়সের মানুষের হৃদয়কে করে চঞ্চল। কিন্তু বর্তমানে করোনা ভাইরাসের থাবায় দীর্ঘদিন যাবত পর্যটকদের জন্য এই উদ্যানটি বন্ধ থাকায় সৌন্দর্য উপভোগ করার নেই কোন পর্যটক।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলার ধামইরহাট উপজেলার ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মধ্যে আলতাদীঘি অন্যতম। প্রায় ২৬৪.১২ হেক্টর বনভূমির মধ্যে দীঘিটির আয়তন ৪৩ একর। এটি দৈর্ঘ্যে ১১০০ মিটার এবং প্রস্থ ৫০০ মিটার। পাহাড়ের মতো পাড়গুলো উঁচু এবং দক্ষিণ পাড় শালবনে ঢাকা। পুরো জায়গায় শোভা পাচ্ছে রাশি রাশি পদ্মফুল। প্রাচীন দীঘির মধ্যে এটিই বোধ হয় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সচল দিঘি।
ধামইরহাট উপজেলায় মোট বনভূমির পরিমাণ ১৪০১.৬৯ একর। ভারতের কোল ঘেঁষে আলতাদীঘি ও তৎসংলগ্ন বন এলাকার ২৬৪.১২ (৬৫২.৩৭ একর) হেক্টর জায়গাকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০১১ সালে এই দীঘিকে ‘আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা করেছে। বিশাল দীঘি রামসাগরের দৈর্ঘ্য এটির চেয়ে ১৫০ মিটার বেশি হলেও চওড়ায় ১৫০ মিটারের কম। আর রামসাগর ১৭৫০ সালের দিকে খনন করা হয়। কিন্তু আলতাদীঘি পাল রাজ্য শাসনের সময় তৈরি করা হয়েছে বলে ধারনা করা হয়।
বরেন্দ্র অঞ্চলে এক সময় প্রবল খরার কারণে মাঠ-ঘাট সব পুড়ছিল চরম পানীয় সংকটে। প্রজাদের দাবির কারণে স্থানীয় জগদল বিহারের (১০৭৭-১১২০ খ্রিষ্টাব্দে) রাজা রামপাল ও সদর পালের রাজ্য শাসনের সময় রাজমাতা ছেলের কাছে বর চাইলেন। ওয়াদা করে নেন, সকালে ঘুম থেকে ওঠে আমি যতদূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতে পারব, ততদূর পর্যন্ত একটি দীঘি খনন করে দিতে হবে। বৃদ্ধ মা হেঁটে চলেছেন তো চলেছেন আর থামেন না। রাজা, উজির, নাজির পড়লেন বেকায়দায়। এত লম্বা দিঘি খনন করবেন কি করে? তাই কৌশলে মায়ের পায়ে আলতা ঢেলে দিয়ে পা কেটে গেছে বলে তার চলার পথ বন্ধ করে দেন। সেই থেকে এই দীঘির নামকরণ করা হয় আলতাদীঘি।
কোলাহল, বনভূমি সংকোচন ও বন্য প্রাণী হত্যার ফলে উদ্যান এলাকার জীববৈচিত্র্যি এখন অনেকটাই হুমকির মুখে। দিন যতই যাচ্ছে ততই বন এলাকায় ভবঘুরে ও ভূমিহীন মানুষদের জনবসতি গড়ে উঠছে। এতে করে উদ্যানের বন নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক ভাবে শালবন এখানকার প্রধান বৃক্ষ হলেও আজ তা ক্ষয়িষ্ণু প্রজাতির বৃক্ষ। সহযোগী প্রজাতি যেমন আমলকী, হরীতকী বহেরা, শিমুল, কুম্ভি, তেন্ডু ইত্যাদি এখন আর নেই বললেই চলে। খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে এলাকাটি এখন বন্য প্রাণীশূন্য। অথচ একদা এলাকাটিতে প্রচুর শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল, খেঁকশিয়াল, গুইসাপ ও হরেক রকমের পাখির কলকাকলিতে পরিপূর্ণ ছিল। বনবিট কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে শালবন বনাঞ্চল ও আলতাদীঘি পর্যন্ত পাকা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।
বর্তমানে বাস, মাইক্রোবাস, ভটভটি ও রিকশা-ভ্যানযোগে ধামইরহাট থেকে আলতাদীঘি পর্যন্ত চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ অনায়াসে পাড়ি জমানো সম্ভব। প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা শালবাগানে বন বিভাগের উদ্যোগে ইতোমধ্যে ঔষধিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, বাঁশ ও বেত লাগিয়ে বন্য প্রাণী ও পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এ বনাঞ্চলে অজগর, হুনুমান, বানর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু, মেছোবাঘ, বনবিড়াল, শিয়ালসহ প্রায় ২০প্রজাতির পাখি অবমুক্ত করা হয়েছে। একদিকে পর্যটক ও দর্শকদের আনন্দ ও বিনোদন যেমন বেড়েছে, তেমনি এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজার রাখার জন্য এ বনাঞ্চল যথেষ্ট অবদান রাখছে।
সাননিউজ/ জেআই