দেশবাসীর উদ্দেশে ফেসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন ফ্রিল্যান্সার আনারুল ইসলাম ওরফে টুটুল (৩৫)। স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, ‘৩ মাস ধরে আমার ঘরে খাবারের কষ্ট। আমার বউ অনেক কষ্টে খাবার জোগাড় করতেছে। কথাগুলো লিখতে লিখতে অনেক কাঁদলাম।’
মঙ্গলবার (১ জুন) দুপুরে বাসার ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার বাড়ি রাজশাহী নগরের হোসেনিগঞ্জ। তিনি পাশের শেখপাড়ায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।
আউটসোর্সিংয়ের প্রশিক্ষণদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার শিকার প্রায় ৪ হাজার ফ্রিল্যান্সার ঘোষণা দিয়েছিলেন, এক মাসের মধ্যে টাকা না পেলে তারা একযোগে আত্মহত্যা করবেন। ঘোষণার আড়াই মাসের মাথায় সত্যিই আত্মহত্যা করেছেন এক ভুক্তভোগী।
ফেসবুকে লেখা স্ট্যাটাসে আনারুল ইসলাম ‘রেক্স আইটি ইনস্টিটিউট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা পাওয়ার দাবি করেছেন। ওই প্রতিষ্ঠানে তাঁর ‘ব্যাচ নম্বর ১৬৬’ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম আবদুস সালাম পলাশ।
আনারুল ইসলামের মরদেহ উদ্ধারের পর তাঁর স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে ফেসবুকে ‘আনমাস্কিং পলাশ অ্যান্ড রেক্স আইটি ইনস্টিটিউট’ নামে একটি গ্রুপের সন্ধান পাওয়া যায়। এতে গত ১১ মার্চ তারিখে ‘পলাশের শাস্তি চাই বিনিয়োগকারী ফ্রিল্যান্সারদের টাকা ফেরত চাই’ শিরোনামে একটি ব্যানার পোস্ট করা দেখা যায়। সেখানে ৪ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এই প্রতিষ্ঠানের কাছে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা বলেছেন, এক মাসের মধ্যে টাকা ফেরত না পেলে আত্মহত্যা ছাড়া তাদের দ্বিতীয় কোনো পথ থাকবে না।
আনারুল ইসলাম দুই মেয়ে ও এক ছেলের বাবা। তাঁর স্ত্রী রুবি বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, রাতে তাঁর স্বামী নিজ কক্ষে কাজ করছিলেন। ফজরের নামাজের সময় ডাকলে সাড়া দেননি। বেলা ১১টার সময়ও ডেকে সাড়া না পেয়ে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে।
আনারুলের ১০ বছরের মেয়ে রুকু বলে, ঘুমানোর আগে বাবা আমার কানে ওষুধ দিয়ে দিয়েছেন। আর বলেছেন, বাবা মারা গেলে আমি যেন মাকে জ্বালাতন না করি।
স্ট্যাটাসে আনারুল ইসলাম তার শারীরিক অসুস্থতা, ব্যবসা করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পুরো বিবরণ তুলে ধরেছেন এবং পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, অনেক ইনভেস্ট অনেক লস, কোনোভাবেই সব ঠিক করতে পারছি না। যত দিন থেকে এই অনলাইন জগতে এসেছি, একটা রাত আরামে ঘুমাতে পারিনি। শুধু টেনশন আর টেনশন। কাকে বলব আমার দুঃখের কথা। কাউকে তো পাশে পাব না। আমি মানসিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত।
তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। উদ্দেশে বলেছেন, তোমরা আমাকে মাফ করে দিয়ো গো। আমি অনেক চেষ্টা করলাম, কোনোভাবেই কিছু করতে পারছি না। অনলাইন জগতে কেউ কাউকে হেল্প করতে চায় না। অনেক চেষ্টা করলাম বেঁচে থাকার জন্য, কিন্তু পারলাম না। কোনোভাবেই কাজ হচ্ছে না। আমি বেঁচে থাকলে আরও ঋণ বেড়ে যাবে। তার থেকে আমি চলে যাই।
আত্মীয়স্বজনের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, তার স্ত্রী খুব সাদাসিধে মানুষ। স্বামীর জন্য নিজের গয়না বিক্রি করে দিয়েছেন। তাকে খুব ভালোবাসেন। দুই মাস ধরে সারা দিন কাজ করেন। স্বামীর জন্য তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে দোয়া করেন। তার এই কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না।
দেশবাসীর উদ্দেশে লিখেছেন, আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ের জন্য কিছু করে যেতে পারলাম না। তবে আমি বেঁচে থাকলে আরও ঋণ বেড়ে যাবে, তাই চলে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নাই। যদি সম্ভব হয় আমার স্ত্রী, ছেলে–মেয়ের থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন আপনারা।
বোয়ালিয়া থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মন বলেন, দুপুর ১টার দিকে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায় পুলিশ। আর ১৭ লাখ টাকা পাওয়ার বিষয়টি তদন্ত করা হবে।