নিজস্ব প্রতিনিধি: ঋণের কিস্তির মাত্র এক হাজার ১০ টাকা। তা পরিশোধ না করার ঘটনায় বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় নুরুন্নাহার বেগম নামের এক গৃহবধূকে চেক জালিয়াতি মামলা দিয়ে জেল খাটানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বুধবার (১৯ মে) পপুলার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা মামলায় সকালে নুরুন্নাহার বেগমকে গ্রেফতার করে গৌরনদী থানা পুলিশ।
এসময় নুরুন্নাহার বেগমের কোলে তার ১২ মাস বয়সী দুধের সন্তান ছিল। সন্তানকে স্বামীর কোলে তুলে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নুরুন্নাহার বেগম।
ওই দিন দুপুরে নুরুন্নাহার বেগমকে আদালতের মাধ্যমে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনা জানাজানি হলে পুরো উপজেলায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। পপুলার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিচার দাবি করেন এলাকাবাসী।
অবশেষে বৃহস্পতিবার (২০ মে) বিকেলে জামিনে মুক্তি পান নুরুন্নাহার বেগম। কারাগার থেকে রাতে বাড়ি ফেরেন তিনি।
নুরুন্নাহার বেগম বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর ইউনিয়নের বাসুদেবপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সেলিম হাওলাদারের স্ত্রী। সেলিম হাওলাদার ক্ষুদ্র একজন ব্যবসায়ী। ২০১৯ সালে সেলিম হাওলাদারের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়।
ওই বছর পপুলার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির বাটাজোর বন্দর অফিস থেকে ৩০ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে স্বামীকে দিয়েছিলেন স্ত্রী নুরুন্নাহার বেগম।
ভুক্তভোগী নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘২০১৯ সালে পপুলার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির বাটাজোর বন্দরের অফিস থেকে ৩০ হাজার টাকার ঋণ নিয়েছিলাম। স্বামীর ব্যবসা খারাপ যাচ্ছিল। ওই টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
ওই টাকা ব্যবসায় খাটিয়ে স্বামী সেলিম হাওলাদার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। সোসাইটির নিয়মানুযায়ী প্রতি সপ্তাহে ৯০০ টাকা করে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে থাকি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মাল্টিপারপাসের অনুকূলে ২০ হাজার ১০০ টাকা পরিশোধ করি এবং সঞ্চয় বাবদ ৮ হাজার ৯০ টাকা জমা দিয়েছিলাম।’
‘করোনার কারণে স্বামী সেলিম হাওলাদারের ব্যবসা লোকসানের মুখে পড়ে। সংসারে আর্থিক অনটন দেখা দেয়। এরপরও মাল্টিপারপাসের কিস্তির টাকা পরিশোধ করার চেষ্টা করে গেছি।
তবে ২০২০ সালের মার্চের দিকে মাল্টিপারপাসের বাটাজোর অফিস বন্ধ থাকায় কিস্তি পরিশোধ সম্ভব হয়নি। ফলে কিস্তি বাবদ এক হাজার ১০ টাকা মাল্টিপারপাসে জমা দেয়া হয়নি।’
‘দুইদিন আগে গৌরনদী মডেল থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রফিকুল ইসলাম বাসুদেবপাড়া কালীবাড়ি বাজারে গিয়ে আমার খোঁজ করেন এবং তার সঙ্গে থানায় দেখা করতে বলেন।
বুধবার সকালে স্বামী সেলিম হাওলাদারকে নিয়ে থানায় দেখা করি। এসময় কোলে আমার ১২ মাসের সন্তান ছিল। এএসআই রফিকুল ইসলাম জানান, পপুলার মাল্টিপারপাস সোসাইটি কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির অভিযোগ এনে ২০২০ সালে পিরোজপুর আদালতে একটি মামলা করেছেন। ওই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
এরপর তারা আমাকে গ্রেফতার করেন। এসময় আমার কোলে থাকা ১২ মাসের দুধের সন্তানকে তার বাবার কোলে তুলে দেই। পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে আদালত আমাকে জামিন দেন। সন্ধ্যার পর কারাগার থেকে বের হয়ে বাড়ি ফিরেছি’, বলেন নুরুন্নাহার বেগম।
নুরুন্নাহার বেগমের অভিযোগ, সামান্য কয়টা টাকার জন্য তার নামে মামলা দেয়া হয়েছে। সেই মামলায় জেল খাটতে হয়েছে। কিন্তু পপুলার মাল্টিপারপাস সোসাইটি কর্তৃপক্ষ মামলার আগে একবারও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বা কোনো নোটিশ দেয়নি।
তিনি বলেন, ‘তাদের কারণে আমার দুধের সন্তান থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। এটা যে সন্তানের মায়ের কাছে কতটা বেদনাদায়ক তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আল্লাহর কাছে এর বিচার দিলাম।’
গৌরনদী মডেল থানার এএসআই রফিকুল ইসলাম জানান, ২০২০ সালে পিরোজপুর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নুরুন্নাহার বেগমকে আসামি করে চেক জালিয়াতির মামলা করা হয় (যার নম্বর- সিআর- ৪৫৩/২০)। ওই মামলায় পলাতক থাকায় পিরোজপুর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আমলি আদালত নুরুন্নাহার বেগমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
পিরোজপুর থেকে গত ১৮ এপ্রিল নুরুন্নাহার বেগমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাটি গৌরনদী মডেল থানায় পৌঁছে। এরপর গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিলের নির্দেশনা পেয়ে নুরুন্নাহার বেগমকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
নুরুন্নাহার বেগম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির বাটাজোর বন্দর অফিস থেকে ঋণ নিয়েছিলেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে কীভাবে অন্য জেলায় (পিরোজপুর) মামলা দায়ের হয়েছে জানতে চাইলে এএসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেফতারি পরোয়ানায় এতো কিছু উল্লেখ থাকে না। তাই এ বিষয় কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে শুনেছি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির প্রধান কার্যালয় পিরোজপুরে।
নুরুন্নাহার বেগম বাটাজোর অফিস থেকে ঋণ নিলেও হয়তো মাল্টিপারপাস কর্তৃপক্ষ কাগজে কলমে প্রধান কার্যালয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া ঋণ দেয়ার সময় হয়তো তারা নুরুন্নাহার বেগমের চেক নিয়েছেন। ওই চেক পিরোজপুরের কোনো ব্যাংকের শাখা থেকে ডিজঅনার করানো হয়ে থাকতে পারে। সেই কারণে নুরুন্নাহার বেগমের নামে পিরোজপুরের আদালতে মামলা হয়ে থাকতে পারে।’
অভিযোগ ও মামলার বিষয় জানতে পপুলার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির বাটাজোর অফিসের একাধিক কর্মকর্তার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এরপর বাটাজোর এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, পপুলার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির অফিসটি বেশকিছু দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি বেশ কিছু দিন ধরে তাদের কোনো কর্মকর্তা বা মাঠকর্মীদের এলাকায় দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘নুরুন্নাহার বেগমকে গ্রেফতারের পর তার বাবা আমার কার্যালয় এসে বিষয়টি জানিয়েছেন। আমি এরপর গৌরনদী মডেল থানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তবে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় থানা পুলিশেরও এ বিষয় কিছু করার ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘পপুলার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির কর্তৃপক্ষ সামান্য টাকার জন্য নুরুন্নাহার বেগমের বিরুদ্ধে মামলা দেবে, এটা চরম নিষ্ঠুরতা। দুধের সন্তান রেখে নুরুন্নাহার বেগমকে জেল যেতে হয়েছে, এটাও দুঃখজনক।’
পপুলার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির বিরুদ্ধে আমানতকারীদের হয়রানি করাসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সাননিউজ/এএসএম