ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম ব্যূরো :
চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ তিনজনেরই হদিস মিলছে না। এই তিনজন হলেন-হত্যাকান্ডের মূল নায়ক কামরুল ইসলাম সিকদার মুছা, প্রত্যক্ষদর্শী মিতুর সন্তান মাহির এবং পরকীয়া প্রেমিকা গায়ত্রী অমর সিং।
সোমবার (১৭ মে) সকালে এমন তথ্য দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা। তিনি বলেন, মিতু হত্যাকান্ডে নেতৃত্¦ দিয়েছেন তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের সোর্স মুছা। কিন্তু হত্যাকান্ডের পর থেকে তার হদিস মিলছে না।
তার স্ত্রী পান্না আক্তারের তথ্যমতে, ঘটনার দিনগত রাতে ডিবি পরিচয়ে মুছাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে সে কোথায় আছে, বেচে আছে, না কি মরে গেছে এই ব্যাপারে কোন খোঁজ নেই। মুছার সন্ধানে সে সময় তিনি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন।
এরপর মুছাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে সিএমপি। এরপরও গত ৫ বছরেও মুছার হদিস মেলেনি। মিতু হত্যর আসল রহস্য প্রকাশে মুছার সাথে কথা বলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মত প্রকাশ করেন পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা।
এদিকে হত্যাকান্ডের সময় প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মিতুর শিশু সন্তান মাহির। ঘটনার সময় হত্যাকারীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে মাকে বাচানোর চেষ্টা করে সে। এই বিষয়ে সতর্কতার সহিত মিতুর সন্তানের সাথে আগেও কথা বলেছে পুলিশ। তদন্তের স্বার্থে মিতুর সন্তানের সাথে আবারো কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। কিন্তু এখন তার হদিসও মিলছে না।
পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, বাবুল আক্তার খুনের বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য দিচ্ছে না। পাঁঁচ দিনের রিমান্ডে সে কথা বলেছে খুবই কম। গায়েত্রী সিংয়ের সাথে পরকীয়া সম্পর্কের কারণে দাম্পত্য জীবনের কলহের কথা স্বীকার করলেও মিতু হত্যার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান বাবুল আক্তার।
বাবুল আক্তার জিজ্ঞাসাবাদে ঢাকায় সন্তানদের নিয়ে কোথায় থাকেন তার সঠিক তথ্যও দেননি। গড়িমসির পর বাসার ঠিকানা দিলেও সেখানে গিয়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে পৌছার আগেই তার বর্তমান স্ত্রী মিতুর সন্তান মাহির ও তাবাস্সুমকে নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে।
এদিকে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনও নাতি-নাতনির খোঁজ না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, হত্যাকান্ডের পর নাতি-নাতনিকে নিয়ে আমার বাসায় উঠেছিল বাবুল আক্তার। কিন্তু এই হত্যাকান্ডে তার সম্পৃক্ততার কথা বলার পর নাতি-নাতনিকে নিয়ে চলে যায় বাবুল আক্তার। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত নাতি-নাতনি বাবুল আক্তারের কাছেই ছিল। গ্রেপ্তারের পর তারা কোথায় এবং কি অবস্থায় আছে তার কোনো হদিস মিলছে না। নাতি-নাতনিকে কাছে পেতে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হবেন বলে জানান।
এছাড়া যার সাথে পরকীয়ার কারণে মিতুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে সেই এনজিও কর্মকর্তা গায়ত্রী অমর সিংও এখন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। তার সাথে কথা বলাও এই মামলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন সন্তোষ কুমার চাকমা।
তিনি বলেন, বাবুল আক্তারের সঙ্গে ভারতীয় নাগরিক গায়ত্রী অমর সিংয়ের পরকীয়ার যে অভিযোগ মিতুর বাবা মামলার এজাহারে করেছেন, তা তদন্তে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। গায়ত্রী সিং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক ইউএনএইচসিআর প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে প্রতিরোধ শাখার একজন কর্মকর্তা হিসেবে কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে তখন বাবুল আক্তার কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাদের পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে উঠে।
মূলত গায়েত্রী সিংয়ের সঙ্গে বাবুলের প্রেমের বিরোধ থেকেই স্ত্রী মিতুকে সরিয়ে দিতে তিন লাখ টাকার কিলিং মিশনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন বাবুল আক্তার। কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেন তারই ঘনিষ্ট সোর্স মুছা। আর চুক্তির তিন লাখ টাকা বাবুলের বন্ধু সাইফুলের মাধ্যমে মুছার এক আত্নীয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। সাইফুলের সাথে মামুন নামে বাবুলের এক বন্ধুও ছিল। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় এ সংক্রান্ত জবানবন্দি দিয়েছেন। এ থেকে নিশ্চিত যে, মিতু হত্যার মাস্টারমাইন্ড বাবুল আক্তার।
গত মঙ্গলবার (১১ মে) এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে হত্যা মামলায় স¤পৃক্ততা মেলায় বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নেয় পিবিআই। তবে আইনিভাবে বাদিকে গ্রেপ্তারের সুযোগ না থাকায় আদালতে তাকে হাজির করার পর তার শ^শুড় মোশাররফ হোসেনের করা নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই। একই সাথে বাবুলের করা মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু রিমান্ডে মুখ খুলছে না বাবুল আক্তার। ফলে মামলায় তিন ব্যক্তির সাথে কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তবে গায়ত্রী অমর সিং এখন ইউরোপে অবস্থান করলেও কক্সবাজারে থাকাকালীন তার বাসার গৃহকর্মীর খোঁজ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। যে কোনও সময়ে ওই গৃহকর্মীর কাছে গায়েত্রী-বাবুলের পরকীয়া স¤পর্কে জানতে চাওয়া হবে। এছাড়া মুখ না খোলায় ফের ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আজ সোমবার বাবুল আক্তারকে আদালতে তোলা হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে প্রকাশ্য সড়কে গুলিতে ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই দিন রাতে তার স্বামী তৎকালীন পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত এসপি বাবুল আক্তার বাদি হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। শুরু থেকে চট্টগ্রামের ডিবি পুলিশ মামলাটির তদন্ত করে। তারা প্রায় তিন বছর তদন্ত করেও অভিযোগপত্র দিতে ব্যর্থ হয়। পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালত মামলাটির তদন্তের ভার পিবিআইকে দেয়।
পিবিআইয়ের তথ্যমতে, ১২ মে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মিতুর বাবার করা মামলায় প্রধান আসামি বাবুল আক্তার। অপর আসামিরা হলেন, কামরুল ইসলাম সিকদার মুছা, এহতেসামুল হক ভোলা, মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, খায়রুল ইসলাম, সাইফুল ইসলম সিকদার ও শাহজাহান মিয়া।
এদের মধ্যে ওয়াসিম ও আনোয়ার আগে থেকেই জেলে। আদালতের নির্দেশে তাদের আবারো শ্যোন এরেষ্ট দেখানো হয়েছে গত শনিবার। বাবুল আক্তার ও সাইদুল ইসলাম সাকু মিতুর বাবার দায়ের করা মামলায় রিমান্ডে আছেন। ভোলা ও শাহজাহান জামিনে মুক্তি পেয়ে পলাতক রয়েছেন। শুরু থেকে অধরা মুছা ও কালু। এদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা।
সান নিউজ/আইকে