রেজাউল করিম, সিরাজগঞ্জ : তাঁতশিল্প সমৃদ্ধ বেলকুচি, চৌহালী, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, কামারখন্দ, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও উল্লাপাড়ার তাঁত পল্লীগুলোতে হারিয়ে যেতে বসেছে নিশি পোহানো তাঁতের শব্দ । ফলে বাপ-দাদার পেশা হারিয়ে বেকার প্রায় লক্ষাধিক তাঁতশ্রমিক।
কারণ হিসাবে তাঁতিরা বলছেন, সুতার মূল্য ৩ মাস পূর্বে যা-ছিল বর্তমানে দ্বিগুণের অধিক হয়েছে, পক্ষান্তরে উৎপাদিত কাপড়ের মূল্য বৃদ্ধি করতে পারছেনা। ফলশ্রুতিতে তাঁতিরা পুঁজি হারিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছে। স্থানীয় সুতার মিলের মালিকগণ দফায় দফায় ইচ্ছামাফিক সূতার মূল্য বৃদ্ধি করছে। কারণ হিসাবে তুলার মূল্য বৃদ্ধির কথা বলছে মিল মালিকরা।
কিন্তু বাজার বিশ্লেষণ করে জানা গেলো তুলার মূল্য বেড়েছে পাউন্ড প্রতি ২০-৩০ টাকা। কিন্তু-সেই সুযোগ নিয়ে সুতার মূল্য বৃদ্ধি করেছে প্রতি পাউন্ডে ১৫০-২০০ টাকা । রং ও ক্যামিক্যালের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ।
মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সুতা, রং ও রাসয়নিক দ্রব্যের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি হওয়ায় লোকসান গুণতে হচ্ছে তাঁত মালিকদের। ৩ মাস আগে যে কাপড় তৈরি করতে ৪০০টাকা খরচ পড়তো, সেই কাপড় এখন তৈরি করতে ৮০০ টাকা খরচ পড়ছে। কিন্তু তাদের উৎপাদিত কাপড় এতো দামে বিক্রি হচ্ছেনা। এমতাবস্থায় তাঁত মালিকরা বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিচ্ছে তাঁত কারখানা। এ পর্যন্ত ৩০ ভাগ তাত বন্ধ হয়ে গেছে। এতে লক্ষাধিক তাত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় তাঁতি সমিতির সভাপতি মোঃ মনোয়ার হোসেন বলেন,বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড করোনা কালিন সময়ে এবং বর্তমান সুতা, রং ও ক্যামিক্যালের ঊর্ধ্বমূল্যের বিষয়ে এ যাবৎ কোন সহযোগিতা বা তাঁতিদের কল্যাণে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নাই ।
কিন্তু তাঁত বোর্ড গঠনের উদ্দেশ্যই হল তাঁতিদের কল্যাণ করা বা তাঁতিদের সমস্যার সমাধান করা, কিন্তু তার সামান্যতম পদক্ষেপও পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।
গোপালপুর গ্রামের তাঁত মালিক রুহুল আমিন,খুকনী গ্রমের তাঁত মালিক অনিক আহমেদ ও সোহাগপুর গ্রামের তাঁতমালিক সফিকূল বলেন, রং-সুতা ও তাঁত সরঞ্জামের দাম বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে তাঁত শিল্প টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে। তাঁতিদের সমস্যা সমাধানে বা তাঁতশিল্পের উন্নয়নে তাঁতবোর্ড থাকলেও তাঁতিদের এই তাঁতবোর্ড কোন কাজেই আসছেনা।
সোহাগপুর, শাহজাদপুুর,এনায়েতপুর ও চৌহালী এলাকা ঘুরে সাধারণ তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিয়মনীতি থাকলেও বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড গত দুই বছরে তাঁতিদের আমদানি কোন সুপারিশ ইস্যু করছেনা। তারা তাঁত ঋণও পাচ্ছেনা, এমনকি করোনাকালীন কোরো প্রণোদনাও পায়নি।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডে আমলা তান্ত্রিক জটিলতায় তাঁতশিল্পের উন্নয়ন কাজের সিদ্ধান্তগুলো মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে, এতে তাঁতিরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে ফোনে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে সরকারের সঠিক নজরদারি হলেই তাঁত শিল্পকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক একরামুল হক রিজভী।
তিনি বলেন, রং এবং সুতার বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটি মনিটরিং টিম গঠন করা দরকার। এর পাশাপাশি এই শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদেরকে সরকারি ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে তাঁত শিল্পের হারানো ঐতিহ্যে ফিরে আসবে।
বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনিসুর রহমান বলেন, তাঁত শিল্পের সব সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন। এবিষয়ে জেলা প্রসাশন ও সংশ্লিষ্ট উদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
এদিকে সুতা,রং ও রাসায়নিকদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে তাঁত সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জের বেলকুচি,চৌহালী, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর,কামারখন্দ,কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ সদর,রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও উল্লাপাড়া উপজেলা এলাকায় ৫ লক্ষাধিক (বিদ্যুৎ চালিত ও হস্তচালিত) তাঁত রয়েছে,। এসব তাঁতে শাড়ি, লুঙ্গি উৎপাদনের জন্য কাজ করছে প্রায় ১২ লাখ তাঁতশ্রমিক।
পর্যায়ক্রমে এসব তাঁত বন্ধ হয়ে গেলে এই ১২লাখ তাঁতশ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে ৩০ভাগ তাত বন্ধ হয়ে গেছে, লক্ষাধিক তাঁতশ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।
সান নিউজ/আরএস/এসএম