জাহিদ হাসান মাহমুদ মিম্পা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ : সীমান্তের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনামসজিদ স্থলবন্দর। ১৯৯৫ সালের ২০ ডিসেম্বর শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে স্থলবন্দরটি চালু হওয়ার পর এই এলাকার শ্রমজীবীদের কাজের চিন্তা নেই।
সীমান্ত ঘেঁষা শাহবাজপুর ও দায়পুখুরিয়া এই দুই ইউনিয়নের দৈনিক প্রায় ৫ হাজার দিনমজুর এখন কাজ করছে স্থলবন্দরে। এদের মধ্যে সোনামসজিদ স্থলবন্দরের পানামা পোর্ট লিংক-এর ভেতরে নিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা ১২৬৬ জন। বাকি প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শ্রমিক ফলমূল, গম, ভুট্টা, মসলা, বিভিন্ন কৃষিপণ্য, পাথর, কয়লা, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পন্য ভারতীয় ও দেশীয় ট্রাকে উঠানামার কাজ করেন। এখন আর বসে থাকতে হয় না কাজের জন্য। তারা সকলেই নিশ্চিত হয়ে ঘুমাতে পারেন। কারণ স্থলবন্দরে পরের দিনের তো বটেই, এমনকি সারা বছরের জন্য কাজ প্রস্তুত আছে।
এই একটি স্থলবন্দরই এখন উপার্জনের কর্মস্থল প্রায় ৫ হাজার দিনমজুরের। রুটিরুজির ব্যবস্থা হচ্ছে ৫ হাজার পরিবারের। স্থলবন্দরের প্রভাব পড়েছে তাদের জীবনযাত্রার মানে। তারা এখন স্বপ্ন দেখছেন উন্নত, সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের।
এখানকার একজন নিবন্ধিত শ্রমিক বালিয়াদিঘী পূর্বপাড়া গ্রামের আব্দুস সামাদ (৩০)। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে স্থলবন্দরে কাজ করছি। এখানে কাজ করার আগে কৃষি ক্ষেতে দিনমজুরের কাজ করতাম। দুই দিন কাজ করতে পেলে আরো দুই দিন বসে থাকতে হতো। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়েছে। খুব কষ্টে দিন কাটতো। এখানে কাজ শুরুর পর থেকে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা আয় করি। পরের দিন কাজ পাওয়া না পাওয়া নিয়েও কোন চিন্তা নেই। শুক্রবারেও কাজ চলে সমান তালে।
আরেক শ্রমিক কর্ণখালী গ্রামের নুরুল ইসলাম (৪৫) বলেন, গত ৮ বছর ধরে এখানে কাজ করি। আল্লাহর রহমতে এখানে কাজ করে খুবই ভালো আছি। দুটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, আরেক ছেলেকে ক্লাস সিক্সে পড়াশোনা করাতে পারছি। এমনকি বাড়িতে পোষার জন্য একটি গাভীও কিনেছি। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে স্থলবন্দরে কাজ পাওয়ায়। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ-ভারত সরকার আরো বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখলে অধিক পরিমাণে পন্যদ্রব্য আমদানী-রপ্তানি হবে। এতে শ্রমিকরাও অনেক বেশি লাভবান হবে।
সোনামসজিদ স্থলবন্দরের পানামা পোর্ট লিংক-এর শ্রমিক ঠিকাদার ও মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সেনাউল ইসলাম জানান, স্থলবন্দর চালু হওয়ার আগে শিবগঞ্জ উপজেলা শাহবাজপুর ও দাইপুখুরিয়া ইউনিয়নের বেশিরভাগ মানুষই বিভিন্ন চোরাচালানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। নিজেদের কাজের জায়গা তৈরি হওয়ায় এসব ছেড়েছে তারা।
শ্রমিকদের জন্য বিমার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা বিভিন্ন সময়ে আহত বা নিহত হতে পারে। এতে তাদের জন্য বিমার ব্যবস্থা করতে পারলে আমদানী-রফতানী কার্যক্রম গতিশীল হবে এবং তারাও খুশি থাকবে। এমনকি এতে তাদের পরিবারও সুরক্ষা পাবে।
সোনামসজিদ স্থলবন্দরের পানামা পোর্ট ম্যানেজার মাইনুল ইসলাম বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে স্থলবন্দর থেকে ৪৮১ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি তা ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এতে অবশ্যই শ্রমিকদের বড় ভ‚মিকা রয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে শ্রমিকদের বিমার বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
আমদানী-রফতানীকারকদের সংগঠন সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট এ্সোশিয়েনের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকার শ্রমজীবীদের জন্য সবচেয়ে বড় কাজের ক্ষেত্র সোনামসজিদ স্থলবন্দর। অন্যদিকে সরকারেরও উচিত শ্রমিকদের উন্নয়নে কাজ করা। কারণ এখনো পণ্য বোঝায় ও খালাস করতে একমাত্র অবলম্বন শ্রমিকরাই। এই এলাকার শ্রমজীবীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সোনামসজিদ স্থলবন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলেও জানান তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল বলেন, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিবেচনায় ইতোমধ্যে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসাপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আশা করি, খুব দ্রুতই নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এছাড়াও করোনাকালে খাদ্যসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। এমনকি দুই ঈদে তাদের বোনাস ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে। বিভিন্ন কোন্দলের কারনে সকল শ্রমিকদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ সফল করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, আগামীতে সকল শ্রমিকদের জন্য বিমা চালুর বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে আলোচনা করা হবে।
সান নিউজ/কেটি