ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম ব্যূরো : লাগাম ছাড়াই বাড়ছে রড-সিমেন্ট, বালি ও ইটসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রীর দাম। আর তাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে চট্টগ্রামের উন্নয়ন খাতে। এ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন খাতের ঠিকাদাররা।
ঠিকাদাররা বলছেন, গত জানুয়ারি মাস থেকে ক্রমেই বাড়ছে রড, সিমেন্ট ও বালিসহ নির্মাণ সামগ্রীর দাম। তন্মধ্যে খাড়ার ঘা হয়ে দাড়িয়েছে ইট। অবৈধ ইটভাটা বন্ধের অজুহাতে ইটের দাম বেড়েছে ৫০ ভাগেরও বেশি। যার প্রভাব পড়ছে সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো উন্নয়ন, সেতু, সড়ক সংস্কার ও নির্মাণ উন্নয়ন কাজে। এতে লোকসান গুণতে হচ্ছে। ফলে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ সভাপতি আব্দুল কৈয়ূম চৌধুরী বলেন, মহামারি করোনার কারণে আমরা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলাম, সেটি এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার ওপর রড, সিমেন্ট, ইট, বালিসহ নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্রীষ্ম মৌসুমে দেশে পুরোদমে অবকাঠামো উন্নয়নমূলক কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু করোনার সময়ে নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদনের মূল কাঁচামাল উৎপাদন তেমন হয়নি। যার ফলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় পার্থক্য তৈরি হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ায় দেশে প্রস্তুত সিমেন্টের দামও বেড়েছে।
এছাড়া অবৈধ ইটভাটা বন্ধের অজুহাত দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ইটের দামও বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা সবাই পরিবেশ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারের অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা উচিত। যাতে নির্মাণ শিল্পে প্রভাব না পড়ে।
আব্দুল কৈয়ূম চৌধুরী বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়লেও আমরা গ্রাহকের ক্রয় ক্ষমতার কথা চিন্তা করে ফ্ল্যাটের দাম বাড়াচ্ছি না। এতে আবাসন খাতে নতুন করে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
তিনি আরও বলেন, দেশে বর্তমানে-বেশ কয়েকটি সরকারি মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান আছে, তাই শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৎপরতায় প্রস্তুতকারকরা চলতি মাসে রডের দাম টনপ্রতি ৩ হাজার টাকা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়।
তথ্যমতে, চট্টগ্রামে বর্তমানে ৩২টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন, চট্টগ্রাম সিএমপির ব্যারাক ভবন, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সার্ভার স্টেশন, চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর সরকারি গুদামাগার (সিটি কর্পোরেশন), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন প্রকল্প, চট্টগ্রাম বন্দর, ওয়াসা, রেলওয়ে, সিডিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে এসব প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা (বঙ্গবন্ধু টানেল ও বে টার্মিনাল ব্যতীত)।
কিন্তু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে ঠিকাদারদের। এই পরিস্থিতিতে সিন্ডিকেটকে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াসহ নির্মাণসামগ্রীর মূল্য নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন ঠিকাদার ও রিহ্যাব।
মো. হাসান নামে এক ঠিকাদার জানান, গত এক মাসের মধ্যে এলসি পাথরের দাম পাইকারিতে প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, সিমেন্টে ২০ থেকে ৪০ টাকা, প্রতি ইটের দাম ৫ থেকে ৮ টাকা, রড প্রতি টনে দাম ৭২ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
মো, হাসান বলেন, যে প্রকল্পগুলো আগামী ৬ মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে সেগুলোর কাজ শেষ করতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। কারণ নির্মাণ সামগ্রীগুলোর দাম বাড়ার কারণে আমাদের ব্যয় বেড়েছে। অথচ বিভিন্ন প্রকল্প চলতি বছরের জানুয়ারিতে স¤পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি ও অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে যথাসময়ে শেষ না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। প্রকল্পগুলো পুনঃমূল্যায়ন না হলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বো।
চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের এম জে ট্রেডিং এর স্বত্ত্বাধিকারী ফরিদুল আলম বলেন, আমাদের নির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে অন্যতম উপাদান হলো রড ও সিমেন্ট। গত কয়েক মাস ধরে এই রড ও সিমেন্টের কাচাঁমালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে উর্ধ্বমুখী। এছাড়া পণ্য পরিবহনের চাপে জাহাজ ভাড়াও গত নভেম্বর থেকেই বাড়তি।
ফলে গত জানুয়ারি থেকেই স্টিল কোম্পানিগুলো রডের দাম বাড়িয়ে আসছে। ফলে সকল ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ডে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো অনেক লোকসানে পড়ছে। শুধু আমরা না, সরকারেরও উন্নয়ন কর্মকান্ডের খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ হাউজিং এন্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটর প্রিন্সিপাল রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বর্ষা মৌসুমে আগে ও নতুন অর্থ বছর শুরু হওয়ার আগে যে কোনো আবাসন ও উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ করে সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু রড, সিমেন্ট. বালি ও ইটসহ অন্যান্য সামগ্রীর দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ফলে আবাসন শিল্প ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে সরকারকে কাজ বুঝিয়ে দিতে হিমশিম খাচ্ছে ঠিকাদাররা। এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে লোকসানের মুখে পড়ছেন ঠিকাদাররা।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে অবৈধভাবে পরিচালিত সব ইটভাটা বন্ধে গত তিন মাসে তিনবার সময় বেধে দিয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু এই তিন দফায় ৩৯ দিন সময় পার হওয়ার পরও দিব্যি ইট পোড়ানো চালু রেখেছে এসব ইটভাটা মালিক।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকা এবং সরকারি নিয়ম বহির্ভূতভাবে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর দায় ও অবৈধভাবে কাঠ পোড়ানো এবং ফসলি জমি নষ্ট করার অভিযোগে এসব ইটভাটাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বিপুল অংকের জরিমানাও করা হয়। এই জরিমানার লোকসান পোষাতে ইটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান একাধিক ইটভাটার মালিক।
সান নিউজ/বিএস