ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম ব্যুরো: পবিত্র রমজান শুরু হতে প্রায় এক মাস বাকি। অথচ ভোজ্য তেল, চাল, চিনি, পেঁয়াজ, ডাল, ছোলাসহ রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্যের দামে উত্তাপ ছড়াচ্ছে আরও আগে থেকে। ভোজ্য তেল বিক্রিতে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না কেউই।
পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফার নেশায় মাতোয়ারা হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা। এমন অভিযোগ সাধারণ ক্রেতাদের। অপরদিকে রোজার আগেই ক্রেতারা বেশি পণ্য কিনে মজুদ করায় দাম বাড়ছে বলে দাবি বিক্রেতাদের।
শুক্রবার (১৯ মার্চ) চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ঘুরে দেখা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য চাল, ডাল, ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহে কোনো সঙ্কট নেই। পণ্য কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, ভোগ্যপণ্য আমদানির সংকট নেই। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে না আসায় আমদানিকারকরাও বাড়তি দামে পণ্য আমদানি করছেন। পাশাপাশি রপ্তানিকারক দেশগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়া ও জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
আলাপকালে ব্যবসায়ীরা জানান, খাতুনগঞ্জে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতিমণ (৩৭.৩২ কেজি) অস্ট্রেলিয়ার ছোলা বিক্রি হচ্ছে ২২০০-২৫৫০ টাকার মধ্যে। খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৭৮-৮০ টাকায়। গত এক মাস আগেও একই মানের ছোলা পাইকারি বিক্রয় হয়েছে ১৯২০-২০০০ টাকায়।
বেড়েছে মটরের দামও। স্বাভাবিক সময়ে বাজারে প্রতিমণ মটর বিক্রি হয় ১০০০-১১০০ টাকায়। কিন্তু গত এক মাসের মধ্যে দফায় দফায় বেড়ে বর্তমানে মটর বিক্রি হচ্ছে ১৪০০-১৪৫০ টাকায়। আমদানিকৃত মসুর ডালের দাম এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে মণে প্রায় ৪০০ টাকা। বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া (মোটা জাতের) মসুর বিক্রি হচ্ছে ২৪২৫ টাকায়। যা এক মাস আগে ২০৫০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। খুচরা পর্যায়ে ভালোমানের মসুর ডাল বিক্রয় হচ্ছে কেজিপ্রতি ১২০ টাকায়।
দেশীয় উৎপাদনে দেশের খেসারি ডালের চাহিদা মেটে। আমদানি পণ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে খেসারির দামও। মাত্র এক মাস আগেও বাজারে প্রতিমণ খেসারি বিক্রি হয়েছে ২০৫০ টাকার (কেজি ৫৫ টাকা) নিচে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে কেজি ৭০ টাকার উপরে। আর মুগডাল ১০ টাকা বেড়ে কেজি প্রতি ১৪০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। মটর ডাল ১০ টাকা বেড়ে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মটর ডাল মণপ্রতি বেড়েছে ৪০০ টাকা।
দীর্ঘ দিন ধরে অস্থির রয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় আরেক ভোগ্যপণ্য চিনির বাজার। এক-দেড় মাস আগে বাজারে থাকা বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রতিমণ চিনি বিক্রি হতো ২১০০ টাকার নিচে। এই সময়ের মধ্যে ২৫০ টাকার বেশি বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রতিমণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ২৩৫০-২৩৬০ টাকায়। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত মাসে ৬০ হাজার ৩৩১ টন চিনি আমদানি করা হয়েছে।
বেড়েছে ভোজ্যতেলের দামও। দফায় দফায় বেড়ে বর্তমানে পাইকারিতে প্রতিমণ (৪০.৯০ লিটার) পাম অয়েলের দাম ঠেকেছে ৩৮৫০-৩৯০০ টাকায়। যা এক মাস আগেও ৩৪০০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। প্রতিমণ পাম সুপার অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৪২০০ টাকায়। যা গত মাসে ৩৮০০ টাকার নিচে ছিল। গত মাসে প্রতিমণ সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৪১০০ টাকার মধ্যে। একই সয়াবিন এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫০০ টাকায়।
সরকার ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেদিকে কর্ণপাত করছেন না কোন ব্যবসায়ী। ভোজ্যতেলের মধ্যে প্রতি লিটার সয়াবিন (খোলা) মিলগেটে ১০৭ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১১০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১১৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ১২৩, পরিবেশক মূল্য ১২৭ এবং খুচরা বিক্রয়মূল্য ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ৫৯০, পরিবেশক মূল্য ৬১০ এবং খুচরা বিক্রয় মূল্য ৬৩০ টাকা। প্রতি লিটার পাম সুপার (খোলা) তেলের মিলগেট মূল্য ৯৫, পরিবেশক মূল্য ৯৮ এবং খুচরা বিক্রয়মূল্য ১০৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অথচ খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে লিটারপ্রতি ১৩০ টাকার বেশি দামে। পাম সুপার ১১২ থেকে ১১৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ৫ লিটার সয়াবিন তেল (বোতল) বিক্রি হচ্ছে ৬৪০ থেকে ৬৫০ টাকায়, যা নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি।
একইভাবে কেজিতে ৬ টাকা বেড়েছে চিড়ার দাম। খাতুনগঞ্জে কেজি প্রতি ৪৫ টাকায় বিক্রি হওয়া চিড়া এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকায়। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকায়। তাছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হলুদ কয়েক সপ্তাহ আগে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কেজিতে এখন তা ২০ টাকা বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া ৫০-৬০ টাকার নারকেল এখন ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের আড়তগুলোতে বর্তমানে দেশি, ভারতীয় ও হল্যান্ডের পেঁয়াজ রয়েছে। এরমধ্যে পাইকারিতে প্রতি কেজি ভারতীয় নাসিক জাতের পেঁয়াজ ৩৫-৩৬ টাকা, খাস খালী পেঁয়াজ ২৯-৩১ টাকা ও বেলেডাঙ্গা ২৮-২৯ টাকা বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ভারতীয় এসব পেঁয়াজের মধ্যে নাসিক ৪২-৪৫ টাকা, খাসখালী ৩৬-৩৭ টাকা ও বেলেডাঙ্গা পেঁয়াজ ৩৫ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হতো। সেই হিসেবে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে খাতুনগঞ্জে ভারতীয় পেয়াঁজের দাম কমেছে কেজিতে ৮-১০ টাকা।
গত সপ্তাহে বাজারে দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে মেহেরপুর ৩০-৩২ টাকা এবং ফরিদপুর ৪০-৪২ টাকা। এক সপ্তাহে কেজিতে ৫-৭ টাকা পর্যন্ত কমে বর্তমানে প্রতিকেজি মেহেরপুরের পেঁয়াজ ২৬-২৮ টাকা এবং ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মহিউদ্দিন জুয়েল বলেন, রোজার আরও এক মাস বাকি। প্রতি বছরের মত এবারো ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ এখনো চোখে পড়েনি। অথচ ভোগান্তিতে পড়েছে আমাদের মত সাধারণ মানুষরা।
খাতুনগঞ্জের আল মদিনা ট্রেডার্সের ব্যবসায়ী আব্দুল আওয়াল বলেন, বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি নেই। তবে রোজার আগেই বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশি পরিমানে পণ্য কিনে মজুদ বাড়ানোর কারণে দামটাও বেড়ে গেছে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ স¤পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, রমজানকে ঘিরে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ভালোই রয়েছে। তবে আমাদের বাজারের সাথে আন্তর্জাতিক বাজারদরের ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে আমাদেরকেও বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে হয়।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, রমজানে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। সে হিসেবে প্রতিবছর রমজানের আগেই নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির একটা প্রবণতা থাকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কিন্তু চাহিদা মোকাবেলায় এবার যথেষ্ট পরিমাণে পণ্য আমদানি করা হয়েছে। মার্চ ও এপ্রিল মাসেও পণ্য আমদানি করা হবে। সে হিসেবে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের প্রতি আমাদের আহ্বান-কোন পণ্যের দাম অন্যায্যভাবে যাতে না বাড়ায়।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৯ হাজার ২১৮ টন ছোলা খালাস হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২ হাজার ৫২৬ টন বেশি। সবচেয়ে বেশি ছোলা আমদানি করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়া থেকেই প্রায় ১৮ হাজার ৯৭৯ টন ছোলা আমদানি করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৮ টন মসুর ডাল আমদানি করা হয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, প্রতিবছর রোজা আসলেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে চাল, ডাল, ছোলা, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সরকার এখনই যদি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, রোজার মাসে সাধারণ ভোগান্তিতে পড়বে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, খাতুনগঞ্জে বাড়তি দামে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে এমন অভিযোগ আমাদের কাছে আসছে। সাধারণ মানুষও ভোগ্যপণ্যের বাড়তি দাম দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে অতি শীঘ্রই বাজার মনিটরিং শুরু হবে। এ সংক্রান্ত একটি রোডম্যাপও তৈরি করা হবে। পাশপাশি যারা পণ্যের দাম বাড়াতে কারসাজি করছেন তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
সান নউিজ/আরআই