ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম ব্যূরো : গ্রেফতারের পর চট্টগ্রামে আলোচনায় কেরানীকন্যা নাহিদা রুনাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার শতকোটি টাকা মালিক হওয়া নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে। প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের বান্ধবী হওয়া নিয়েও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতে ছাড়ছে না ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।
এর মধ্যে ইকবাল হোসেন নামে একজন মন্তব্য করেছেন, একজন নারীর বড়গুণ তার সুন্দর চেহারা। আর সম্পদ তার নারীত্ব। চেহারা আর নারীত্ব বিকিয়ে দিলে কত সহজে শতকোটি টাকার মালিক হওয়া যায় নাহিদা রুনাই তার জলন্ত প্রমাণ। এছাড়া অধিকাংশ মন্তব্য আরো কুরুচিপূর্ণ হওয়ায় তা উল্লেখ করা সম্ভব হলো না।
পি কে হালদারের দুর্নীতির সহযোগী ও তার বান্ধবী নাহিদা রুনাইসহ তিনজনকে ১৬ মার্চ মঙ্গলবার রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেফতার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রুনাই পি কে হালদারের ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
দুদকের তদন্ত টিম এর আগে তার ব্যাংক হিসেবে অস্বাভাাবিক লেনদেনের তথ্য পায়। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় অন্তত ৭২ কোটি টাকা! এছাড়া রুনাইয়ের ২৮ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর স¤পদের তথ্যও পেয়েছে দুদক। যা একটি সরকারি দপ্তরে কেরানি পদ-এ চাকরি করা বাবার মেয়ের পক্ষে বৈধভাবে অর্জন অসম্ভব।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নাহিদা রুনাই বহুল আলোচিত পি কে হালদারের অর্থ পাচারের অন্যতম সহযোগী ও বান্ধবী। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে তিনি নিয়মিত অফিস করতেন। নিয়ন্ত্রণ করতেন পি কে হালদারের অন্তত আরও চারটি প্রতিষ্ঠান।
পি কে হালদারের অর্থ আত্নসাৎ ও পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল। তদন্তকারী দুদক দলের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের খুলশী থানার পূর্ব নাসিরাবাদ এলাকার জাকির হোসেন বাইলেন স্থায়ী ঠিকানার বাসিন্দা নাহিদা রুনাই। তাদের বাড়িটি স্থানীয়ভাবে মোজাফফর খানের বাড়ি হিসেবে পরিচিত। রুনাইয়ের বাবার নাম মফিজুর রহমান। তিনি চট্টগ্রামে একটি সরকারি দপ্তরে করণিক পদে চাকরি করতেন। মা তাহমিনা আক্তার গৃহিনী।
রুনাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় এসে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডে চাকরি পান। সেখানে ২০০৯ সাল থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন পি কে হালদার। ২০১১-১২ সালে পি কে হালদারের সঙ্গে পরিচয় হয় রুনাইয়ের। এরপর ঘনিষ্টতা। তারপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এসএমই লোন শাখার অফিস এক্সিকিউটিভ থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধান পি কে হালদারের বান্ধবী বড় আপা হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।
২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন পি কে হালদার। পি কে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে নাহিদা রুনাইকে নিয়ে আসেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে। দ্রুত সময়ে তাকে চারটি পদোন্নতি দিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট করেন পি কে হালদার।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, পি কের টাকা পাচারের অন্যতম সহযোগী এই নাহিদা রুনাই। কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কত টাকা আত্নসাৎ ও পাচার হচ্ছে সেই হিসাব রাখতেন রুনাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন মহলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতে রুনাইয়ের দক্ষতা অপরিসীম। তিনি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতে সিদ্ধহস্ত।
দুদকের অনুসন্ধান দলের একজন কর্মকর্তা বলেন, পি কে হালদারের দখলে থাকা ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজের ১০০ কোটি টাকা নিজের মতো করে খরচ করার সুযোগ পান রুনাই। এছাড়া পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কো¤পানিতে (বিআইএফসি) রুনাইয়ের দাপট ছিল।
দুদকের মামলায় আদালতে দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন পি কের অন্যতম সহযোগী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলামের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে নাহিদা রুনাই ও অবন্তিকা বড়ালের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন তিনি।
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেন, রুনাই ও অবন্তিকার সঙ্গে পি কে হালদারের স¤পর্ক ছিল স্বামী-স্ত্রীর মতোই। আর রুনাই ও অবন্তিকার স¤পর্ক ছিল সতীনের মতো। বিদেশ ভ্রমণ নিয়েও তাদের দুজনের মধ্যে ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা। তারা পৃথকভাবে ২০-২৫ বার সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন। একবার গোপনে অবন্তিকাকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে প্রমোদ ভ্রমণে যান পি কে। রুনাই বিষয়টি জানতে পেরে পি কে হালদারের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালান। অবন্তিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে রুনাই পি কের ওপর কয়েকবার হামলা করে।
গত ১৩ জানুয়ারি অবৈধ স¤পদ অর্জনের মামলায় অবন্তিকা বড়ালকে গ্রেপ্তার করে দুদক। তাকে দুই দফায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন।
দুদক সূত্র জানায়, নাহিদা রুনাইসহ পি কে হালদারের ৪৪ সহযোগীর বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া রুনাইসহ ৩৩ জনের স্থাবর-অস্থাবর স¤পদ বিবরণী জারির নোটিস দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। এছাড়া ৩৩ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যার প্রতিটি মামলার প্রধান আসামি হচ্ছেন পি কে হালদার।
সান নিউজ/বিএস