নিজস্ব প্রতিনিধি, টাঙ্গাইল : স্বাধীনতার পর কেউ আমাকে নিয়ে চিন্তা করেনি। মির্জাপুরের সাংবাদিকরা আমারে নিয়ে সংবাদ লেখার কারণে সরকার আমার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় দিয়েছেন। আজকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে পুরস্কার দেয়ার জন্য ডেকেছেন। আমি সাংবাদিক ও শেখ হাসিনাকে প্রাণভরে দোয়া করি। আল্লাহ যেন সবাইকে ভালো রাখে।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বাঁশতৈল ইউনিয়নের বীরঙ্গনা রবিজান বেওয়া একথা বলেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে পাশবিক নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করার ক্ষেত্রে সোমবার (৮ মার্চ) জাতীয় পর্যায়ে ঢাকা বিভাগে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পান তিনি। তিনি বাঁশতৈল ইউনিয়নের বাঁশতৈল পশ্চিমপাড়া গ্রামের হারাদন আলীর মেয়ে।
সোমবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পাঁচজন জয়িতা প্রত্যেককে এক লাখ টাকার চেক, ক্রেস্ট ও সনদ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে মির্জাপুরের বীরঙ্গনা রবিজান একজন। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা এমপির কাছ থেকে জয়িতারা সম্মাননা পদক গ্রহণ করেন।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী রবিজান বেওয়ার গ্রামে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক বিএসসিসহ আরও কয়েকজনের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ওই দিনই পাক বাহিনীর সদস্যরা বাড়িতে ঢুকে অস্ত্রের মুখে ববিজানসহ আরও কয়েকজন নারীকে পাশবিক নির্যাতন চালায়। অস্ত্রের ভয় আর পাশবিক নির্যাতনে জ্ঞান হারান তিনি। ধর্ষিতা হওয়ার অপরাধে স্বামীর সংসার ছাড়তে হয় তাকে। সরকারি জমিতে ঘর তুলে বসবাস করতে থাকেন তিনি। বয়স হওয়ায় এখন কানেও শোনেন না তেমন, স্মৃতিশক্তিও কমে গেছে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেয়া হয়নি রবিজানকে। পাননি বয়স্ক বা বিধবা ভাতা বা সরকারি কোনো সযোগ-সুবিধাও। উল্টো পেয়েছেন মানুষের লাঞ্ছনা, ঘৃণা ও অপবাদ।
রবিজানের জীবনের এসব ঘটনা তুলে ধরে ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবাদ মাধ্যমে ‘মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান রবিজান’ সংবাদটি প্রকাশিত হয়।
প্রকাশিত সংবাদ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারীর নজরে আসে। তিনি টাঙ্গাইলের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. মাহাবুব হোসেনকে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। দীর্ঘ যাচাই বাছাই শেষে ২০১৯ সালের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৬২তম সভায় ৯ জুলাই রবিজান বেওয়াসহ সারাদেশে ৪৬ জন বীরাঙ্গনার নাম প্রকাশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। যা ২৯ জুলাই গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। একই বছর ১৫ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে রবিজানকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতার ৮২ হাজার টাকার চেক দেয়া হয়।
এছাড়া গত বছর রমজান মাসে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জোবায়ের হোসেন বীরঙ্গনা রবিজানকে সরকারি ৮ শতাংশ ভূমি লিখে ও দখল বুঝে দেন।
বাঁশতৈল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মো. লাল মিয়া বলেন, বীরঙ্গনা রবিজান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। স্বাধীনতার পরও তিনি বিভিন্ন ভাবে নির্যাতিত ছিলেন। সরকার তাকে বীরঙ্গনা খেতাব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিয়েছেন। আজ তিনি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পেলেন। সাংবাদিকরা লেখার কারণে দীর্ঘদিন পর স্বীকৃতি পেলেও এটি খুবই আনন্দের।
রবিজান বলেন, সাংবাদিকরা আমাকে নিয়ে লেখার কারণে ‘দীর্ঘদিন পর হলেও বীরাঙ্গনা খেতাব, সম্মানী ভাতা ও সরকারি জমি পেয়েছি। আজ শেখ হাসিনা আমাকে পুরস্কার দিলেন। এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মির্জাপুরের সাংবাদিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
মির্জাপুর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. জোবায়ের হোসেন বলেন, গেজেট প্রকাশের দিন থেকে তার নামে ভাতা চালু হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সরকারি ৮ শতাংশ ভূমি লিখে ও দখল বুঝে দেয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবে তাকে ঘর দেয়ার প্রস্তুতি চলছে।
সান নিউজ/কেটি/টিকে