মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা: অর্ধেক অর্ধেক কামাই। দালালির শতকরা কমিশন তো আছেই। তাই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র ব্যক্তি উদ্যোগে অর্থের লোভে পরে গাইবান্ধা জেলার আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
সাত উপজেলায় দুই শতাধিক প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও যার বেশিরভাগের নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, কাগজপত্র ও দক্ষ জনবল। হরহামেশা গড়ে ওঠা কথিত এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে নোংরা পরিবেশ, অদক্ষ নার্স ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই চলছে মনগড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা। এতে চরম ভোগান্তি, অর্থনৈতিকভাবে প্রতারিত ও স্বাস্থ্য শংকায় পড়েছে হতদরিদ্র ও বন্যা কবলিত এই জেলার প্রায় ১৮ লাখ মানুষ।
নিয়ম অনুযায়ী, লাইসেন্স পেতে হলে হাসপাতালের যিনি মালিক হবেন তার জাতীয় পরিচয়পত্র, হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন (নতুন প্রতিষ্ঠান) বা আয়কর প্রত্যয়নপত্র (পুরোনো প্রতিষ্ঠান), ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নম্বর, পরিবেশ ছাড়পত্র, মাদকের ছাড়পত্র, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ক্ষতিকর ও অক্ষতিকর) চুক্তিপত্র ও চালানের স্ক্যান কপি অনলাইনে জমা দিতে হয়। এরপর মানসম্মত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য উন্নতমানের যন্ত্রপাতি থাকতে হবে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তার হাসপাতাল পরিদর্শনকালে এসব নিরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে।
হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা, সেবা প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কর্তব্যরত চিকিৎসকের নাম, মোবাইল নাম্বার, কর্তব্যরত নার্স ও টেকনোলজিস এবং প্যাথলজিস্ট এর নাম-ঠিকানা, ছবি, ডাক্তারের বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন, বিশেষজ্ঞ সনদ, নিয়োগ ও যোগদান বা সম্মতিপত্র জমা দিতে হয়। সাহায্যকারীদের তালিকা, অস্ত্রোপচার ও যন্ত্রপাতির তালিকাও হাসপাতালের প্রধানের স্বাক্ষরসহ জমা দিতে হয়।
নিয়ম থাকলেও তা যেন শুধু কাগজ-কলমেই। হাসপাতালগুলোতে নেই গাইনি বিশেষজ্ঞ, অ্যানেসথেসিয়া ডাক্তার, সার্বক্ষণিক ডাক্তার। আবার সার্জারি বিশেষজ্ঞ না হয়েও অনভিজ্ঞ কথিত ডাক্তার কিংবা আয়া-বুয়া দিয়ে করা হচ্ছে নানা ধরনের অপারেশন ও দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। কোনো কোনো ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ মেডিকেলে পড়ুয়া ছাত্র কিংবা ফিজিও থেরাপিস্ট দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা চালাচ্ছেন। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অনুমোদনবিহীন হাসপাতালগুলো বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ওষুধের দোকানদার (ফার্মেসি মালিক) কিংবা দালাল নিযুক্ত করে কমিশনের মাধ্যমে রোগী হাতিয়ে নিচ্ছেন নিয়মিতভাবে। ভালো-মন্দ বিচার না করেই যত্রতত্র গড়ে ওঠা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগী পাঠাচ্ছে দালাল ও ফার্মেসিগুলো। ভুল চিকিৎসার কারণে প্রায়ই এসব চিকিৎসাকেন্দ্রে মারা যাচ্ছে রোগী। অনেকেই বিকলাঙ্গ কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করছেন। যার ফলে মাঝেমধ্যে রোগীর স্বজনরা প্রায়ই হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে কথিত এইসব চিকিৎসাকেন্দ্র।
গাইবান্ধায় ডায়গনিস্টিক ও হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে ১৬৭টি। এর মধ্যে নিবন্ধন আছে মাত্র ৭১টির। আবার নিবন্ধন থাকলেও নবায়ন করা হয়নি অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের। ১০ বেডের অনুমতি নিয়ে কিছু ক্লিনিক খোলা হলেও অতিরিক্ত বেড বসিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ব্যবসা করছে অনেক ক্লিনিক। এতে জন হয়রানির পাশাপাশি সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
এসব হাসপাতাল চলছে অদক্ষ চিকিৎসক, নার্স এবং অনভিজ্ঞ প্যাথোলজিস্ট দিয়ে। যার শিকার হচ্ছেন অসংখ্য দরিদ্র পরিবারের সদস্যসহ সমাজের নানা স্তরের মানুষ। একের পর এক রোগী মারা যাওয়া ও ভুল চিকিৎসায় রোগীর হয়রানি বন্ধসহ অবৈধ কার্যক্রমে জড়িত থাকার অপরাধে বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) বিকেলে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে একটি অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনা করেন সিভিল সার্জন ডা. আ খ ম আখতারুজ্জামান, সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ পুলিশ সদস্যবৃন্দ।
অভিযানকালে অনুমোদনের অতিরিক্ত বেড, অপরিচ্ছিন্ন পরিবেশ, অপারেশন থিয়েটার, ড্রাগ লাইসেন্স না থাকা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স না থাকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যালোচনাপূর্বক এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে সাঘাটা উপজেলার ৬টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের মধ্যে ৪টিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরমধ্যে ১টির ১৫ হাজার ও ৩টির ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা আদায় করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা সিভিল সার্জন আ খ ম আখতারুজ্জামান জানান, কয়েকটি অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত চালানো হয়েছে। অভিযানে প্রতিষ্ঠান গুলোর অবকাঠামোগত সমস্যা ছাড়াও, ডাক্তার, নার্স সংকট পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেনি। করোনা ভ্যাক্সিন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার কারণে অভিযান নিয়মিত করা যাচ্ছে না। এই কর্মসূচি শেষ হলে প্রতিটি প্রতিটি অবৈধ ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করা হবে এবং অনিয়ম পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সান নিউজ/কেটি