ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম ব্যূরো:
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এর মেকানিক্যাল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সৌরভ। থাকেন চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকায়। বৃহস্পতিবার বিকেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার নিজস্ব ওয়ালে মিলল এক আজব মানচিত্র। সেটা মূলত মৃত মশা দিয়ে তৈরী।
সৌরভ তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, বুধবার সন্ধ্যা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দুই ঘন্টায় ৫০০ মশা মেরেছেন তিনি। সেটা দিয়ে তৈরী করেছেন বাংলাদেশের মানচিত্র। বুঝাতে চেয়েছেন এটাই বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র।
চট্টলার অধিকার ফোরামের পরিচালক ও সমাজকর্মী কায়সার আলী তার ফেসবুকে ওয়ালে মশার মানচিত্রের সেই ছবি শেয়ার করে মন্তব্য করেছেন, চসিকের কি কিছু করার নাই, নাকি মশা মারার টাকা নাই, মশার উপদ্রবে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ, এখন এটাই চট্টগ্রামের প্রতিটি বাসার চিত্র।
এভাবে মশা মেরে বাংলাদেশের মানচিত্র, কখনো নিজের নাম, কখনো বন্ধুর নাম লিখে জন্মদিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরে নিজেদের অসহায়ত্বেও কথ জানান দিচ্ছেন চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশাজীবি মানুষ।
আর এসব চিত্র নিয়ে বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) সন্ধ্যায় মুঠোফোনে কথা হয় চসিক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএম রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে। মশার চিত্রকর্মের কথা শুনে শুরুতেই তিনি বলেন, নগরবাসী তো বটেই, স্বযং আমি নিজেও মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ।
মেয়র বলেন, মশার উপদ্রব আসলে খুব বেড়েছে। আমি নিজেও মশা নিয়ে অতিষ্ঠ। ওষুধেও কোন কাজ হচ্ছে না। মূলত শহরের বিভিন্ন এলাকায় খাল খননসহ উন্নয়নমূলক কাজের কারণে বেশিরভাগ এলাকার নালাগুলো বন্ধ। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে পানি জমে থাকার কারণে সেখানে মশা সহজে বংশবিস্তার করছে। আমরা ওষুধ ছিটানোসহ মশক নিধনে বেশ কিছু কর্মসূচি পালন করেছি। কিন্তু নালাগুলোতে পানি জমে থাকায় মশা নিধনে সমস্যা হচ্ছে।
নগরবাসীর অভিযোগ, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে সন্ধ্যার পর মশার জ্বালায় বাসা কিংবা দোকানে কোথাও বসতে পারছেনা সাধারণ মানুষ। দিনেও মশার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউ। কয়েল জ্বালিয়েও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। কেউ কেউ দিনের বেলায়ও মশারি টানিয়ে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে নগরীর সর্বত্র মশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও স্বস্তিতে কাজ করা যাচ্ছে না। যদিও আনুষ্ঠানিক মশার মারার কামান ধরে মশা নিধনে চসিকের ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম উদ্বোধন করেছিলেন নব নির্বাতি মেয়র রেজাউল করিম। তবে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের পর মশা নিধনে চসিক কার্যক্রম চোখে পড়ছে না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
নগরীর বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা তাজুল ইসলাম বলেন, দিন রাত সবসময় মশার মারাত্নক উপদ্রব। নামাজে দাঁড়ালে পায়ে হাতে ২০-৩০টি মশা একসাথে রক্ত খাচ্ছে। সালাম শেষ করে পায়ে হাত বুলালে ১০-১৫ টা মশা হাতে উঠে আসে। আমাদের হাত পর্যন্ত লাল হয়ে যায়। কয়েল অ্যরোসল কোনো কিছুই কাজ হচ্ছে না।
বহদ্দারহাটের বাসিন্দা গুলজার বেগম বলেন, বিল্ডিংয়ের ছয়তলায় থাকি, কিন্তু মশার যন্ত্রণা থেকে নিস্তার নাই। কয়েল দিয়েও কাজ হয়না। সিটি কর্পোরেশন মেয়র আসছে যাচ্ছে কিন্ত আমাদের মত সাধারণ মানুষ যে কষ্টে আছে তাতে তাদের কিছু এসে যায়না। মশার যন্ত্রণায় সন্ধ্যার পর থেকে ছেলেমেয়েদের মশারির ভিতর বসিয়ে রাখি। কিন্তু ছোট ছেলেমেয়েদের কী আটকিয়ে রাখা যায়। চসিক কাজ করে বলে কিন্তু সে কাজের ফল আমরা পাই না।
জুবলী রোডের বাংলাদেশ ব্যাংক কমকর্তা আহসান উল্লাহ বলেন, নতুন মেয়রের নিজের এলাকা বহদ্দারহাটে মশার সাংঘাতিক উপদ্রব। আমাদের এলাকা এখন মেয়র এলাকা বলা যায়। সে হিসেবে আশা করেছিলাম হয়তো মশার উপদ্রব থেকে স্বস্তি পাবো। কিন্তু দেখছি কাজের বেলায় সবাই ক্যামেরার সামনে। নিজ এলাকা কিংবা অন্য এলাকার সাধারণ মানুষের কোন মা বাপ নাই।
আগ্রাবাদ এলাকায়ও আছে মশার উপদ্রব। মশার জ্বালায় রীতিমত অতিষ্ঠ সেখানকার বাসিন্দারা। আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা শহীদ উদ্দিন বলেন, গত এক মাসে তিনি এলাকার মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেননি। দেখেছেন নির্বাচনের হাকডাক আর মিথ্যা আশ্বাস।
অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাসভবন এলাকায় তালিকা ধরে মশার ওষুধ ছিটানো হয়। এছাড়া চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক এলাকায় এ ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করা হয়। অথচ ৪১ ওয়ার্ডের আনাচে-কানাচে বিশেষ করে, মশার প্রজননস্থল বিভিন্ন নালা-নর্দমা ও জমে থাকা পানিতে চসিকের মশক নিধন ¯েপ্রর কার্যক্রম নেই।
সরেজমিন দেখা যায়, নগরীর অধিকাংশ স্থানে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে খাল-নালায় বাঁধ দেয়া হয়েছে। ফলে জমে থাকা পানিতে বাড়ছে মশার প্রজনন। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। নগরীর হালিশহর, আগ্রাবাদ, মুরাদপুর, দুই নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, বাকলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার খাল ও নালা-নর্দমায় গিজগিজ করছে মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা।
চসিকের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন, নগরীর সব ওয়ার্ডে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। কিন্ত বিভিন্ন এলাকায় নালাগুলোতে পানি জমে থাকায় মশার উপদ্রব কমছে না। আমি চাক্তাই খালসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় পরিদর্শনে গিয়েছি। একটি এলাকায় পরিদর্শনে গিয়ে জমে থাকা পানিতে ঢিল ছুড়ে মেরে দেখেছি। ঢিল মারার সাথে সাথে মনে হয়েছে সেখানে মেঘ ভাসছে। এত মশা সেখানে বংশ বিস্তার করেছে। আমরা কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এসব খাল ও নালায় জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করছি। একই সাথে পানিতে কালো তেল ছিটানোর ব্যবস্থা করেছি।
সান নিউজ/