শিপলু জামান, ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের হাতপাখা তৈরির কারিগরদের যেন বাতাস খাওয়ার সময় নেই। শীতের পর গরমের আগমনে মানুষকে একটু শান্তির পরশ দিতে দিন-রাত পরিশ্রম করে তৈরি করছে কালীগঞ্জের হাতপাখা বা তালপাখা তৈরির কারিগররা। পূর্ব পুরুষের ব্যবসা করে এখনো সংসার চালাচ্ছে কালীগঞ্জের প্রায় অর্ধশত পরিবার। গরম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাজ বেড়ে গেছে। তালপাখা তৈরি তাদের পেশা ও বাণিজ্যিকভিত্তিতে তা তৈরি করে থাকে। এদের কোন জমি নাই যে মাঠে কৃষি ফসল চাষ করবে। এদের প্রধান ও একমাত্র পেশা পাখা তৈরি।
ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার দুলালমুন্দিয়া, পারিয়াট, চাচড়া, আড়পাড়া এলাকার পাখা তৈরিকারিরা বলেন, গরম পড়লেই পাখা পল্লীর কারিগরদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। যেন কথা বলার সময় নেই তাদের। শরীর দিয়ে নোনতা পানি বের হলেও নিজেরা পাখা দিয়ে বাতাস খাওয়ার সময় নেই। কেউ বা পাতা কেটে সাইজ করছে, কেউ সেলাই করছে আবার কেউবা পাখা তৈরি করছে কেউ আবার প্রস্তুত হওয়া পাখাগুলো বিক্রির জন্য বোঝা বাধছে।
পাখা তৈরিকারি আব্দুল গফুর বলেন, তাদের পূর্ব পুরুষেরা এই তালপাখা তৈরি করে জীবন জীবিকা চালাতো। ফলে তারাও পূর্ব পুরুষের কাজটি ধরে রেখেছেন।
কালীগঞ্জে প্রায় ৫০টি পরিবার পাখা তৈরির কাজ করে থাকেন। কুষ্টিয়া থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন জানান, কালীগঞ্জের তালপাখা এলাকার ক্রেতাদের কাছে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। প্রতিটি বাড়িতে পাখা তৈরি কাজে এত ব্যস্ত যে কারও কথা বলার সময় নেই। কাজের চাপে অনেকে সকালে ভাত খায় আর রাতে খায়। কাজের চাপের কারণে তারা ভাত খাবার পর্যন্ত সময় পায় না।
পাখা কারিগর নজরুল ইসলাম জানান, পাখা তৈরির প্রধান উপকরণ তালপাতা সংগ্রহ করা হয় শীতকালে। মাগুরা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী এলাকা থেকে তারা পাতা সংগ্রহ করে। এই তালপাতা এনে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর পাতা ভিজে নরম হয়ে গেলে পানি থেকে উঠিয়ে তা কেটে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
একটা পাতায় দুটো পাখা হয়। এই পাতা পুনরায় বেঁধে রাখা হয়। এভাবে রাখার পর গরমের মৌসুম আসার সাথে সাথে সেগুলো আবার পানিতে ভিজতে দেয়া হয়। পানিতে দেবার পর পাতা নরম হয়ে গেলে শুরু হয় মূল পাখা তৈরীর কাজ। সাধারণত পরিবারের বড়রা পানিতে ভিজে নরম হয়ে যাওয়া পাতা ছাড়িয়ে পাখা আকৃতির করে চারিদিক কেটে সমান করে থাকে। আর বাড়ির মেয়েরা সেগুলো বাঁশের সলা দিয়ে বেঁধে ফেলে। পরিবারের ছোট সদস্যরা এগুলো সুচ আর সুতা দিয়ে সেলাই করে থাকে। এভাবে ব্যবহারের উপযোগী একটি তালপাখা তৈরি হয়। বাড়ির ছেলে, মেয়ে, গৃহবধূ ও শিশুরাও সবাই মিলে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১/২টা পর্যন্ত পাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন।
নজরুল আরও জানান, তাদের তৈরিকৃত হাতপাখা পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়। এখান থেকে পাইকাররা প্রতি পিস পাখা ১২-১৫ টাকা দরে ক্রয় করে নিয়ে খুচরা ২০-২২ টাকায় বিক্রি করে। মূলত পাখা ব্যবসা থাকে গরমের ৩-৪ মাস। সরকার যদি সহজ শর্তে লোন ব্যবস্থা করেন তাহলে এই শিল্পটা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। কালীগঞ্জের পাখা বিশেষ করে কুষ্টিয়া,মাগুরা, রাজশাহি, নাটোর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়িরা এসে পাইকারি দরে পাখা কিনে নিয়ে যায়।
গৃহবধূরা জানায়, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দু’বেলার খাবার রান্না করে রাখে তারা।
কালীগঞ্জ উপজেলায় এরা খুচরা ও বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারি হিসাবে বিক্রি করে থাকে। কিন্তু তালপাখা তৈরির কারিগরেরা অন্য সবাইকে তালপাখার বাতাস খাওয়ানোর জন্য পাখা তৈরি করে অথচ নিজেরা কোন সময় পাখার বাতাস খায় না।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুবর্ণারানী সাহা বলেন, তালপাখা তৈরির কারিগরদের জন্য সহজ শর্তে লোন পাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
সান নিউজ/এসজে/এনকে