ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম ব্যুরো : করোনাকালে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এ ঘটনায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) এএমএম শাহনেওয়াজ ও সরঞ্জাম ক্রয় কর্মকর্তা বেলাল হোসেন সরকার বরাখাস্ত হয়েছেন।
এছাড়া নানা অনিয়ম দুর্নীতির কারণে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ২৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও দুদকের তদন্তও চলছে। আর এরই মধ্যে হদিস মিলেছে করোনাকালে দুর্নীতির টাকায় কেনা প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টাকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর।
বিপুল পরিমাণ এই সামগ্রী রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম আগ্রাবাদের সিজিপি ওয়াই ইয়ার্ডের নিচ তলায় একটি গোপন কক্ষে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। যেখানে আগে থাকতেন ইয়ার্ডের নিরাপত্তা রক্ষীরা। গত বছর অক্টোবর মাস থেকে এ কক্ষে বিপুল পরিমাণ এই স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী সম্পূর্ণ অবৈধভাবে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে বলে জানান নিরাপত্তা রক্ষীরা।
নিরাপত্তা রক্ষীরা জানান, সিজিপি ওয়াই ইয়ার্ডের প্রধান মাস্টার আবদুল মালেক নিরাপত্তা রক্ষীদের বের করে দিয়ে এসব করোনার স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী গোপনে তালাবদ্ধ করে রেখেছেন। যার অধিকাংশই এখন নষ্টের পথে। আর নিরপাত্তা রক্ষীরা অনেক কষ্ট করে এখন অন্যত্র মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে সিজিপি ওয়াই ইয়ার্ডের প্রধান মাস্টার আবদুল মালেক সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বরখাস্ত হওয়া সাবেক চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) এএমএম শাহনেওয়াজ স্যারের অনুরোধে করোনা স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীগুলো রাখা হয়েছিল। স্যারের অধীনস্থ হিসেবে আমি অনুরোধ না রেখে পারিনি। কিন্তু বর্তমানে এসব স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে আমি চরম বেকায়দায় পড়েছি।
আবদুল মালেক বলেন, শাহনেওয়াজ স্যার আমাকে বলেছিলেন এসব সামগ্রী ঢাকায় নিয়ে যাবেন। ইয়ার্ড থেকে যেহেতু মালামাল ঢাকায় পাঠানো হয় সে হিসেবে আমি রেখেছি। কিন্তু এরপর দেখি এসব সামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতির কারণে স্যার বরখাস্ত হয়েছেন।
এরপর স্যারের নির্দেশে কিছু সামগ্রী আমি ঢাকায় পাঠিয়েছি। কিন্তু এখনো ১ কোটি ৯০ লাখ টাকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী প্যাকেটজাত অবস্থায় ইয়ার্ডের নিরাপত্তা রক্ষীদের কক্ষে আছে। যা এখন নষ্টের পথে। তাহমিনা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব সামগ্রী সরবরাহ করে। এরমধ্যে রয়েছে স্যানিটাইজার, মাস্ক, হেডক্যাপ, হ্যান্ড গ্লাভস, এন্টিসেপটিকসহ নানা সুরক্ষা সামগ্রী।
কিন্তু বরখাস্ত হওয়ার পর সরকারি মোবাইল ফোন নাম্বারটি শাহনেওয়াজ স্যারের হাতে নেই। স্যারও আমার সাথে এ ব্যাপারে আর কোনো রকম যোগাযোগ করেননি। এসব সামগ্রীর বিষয়ে রেলের বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও কোনো রকম নির্দেশনা আসেনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার নাজমুল হোসাইন বলেন, সিজিপি ওয়াই বা কোনো ইয়ার্ডে এমনকি কোথাও করোনা স্বাস্থ্য সামগ্রী প্যাকেটজাত অবস্থায় তালাবদ্ধ রয়েছে তা আমার জানা নেই। করোনা শুরুর পর যেসব স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় করা হয়েছে তার সবগুলোই চাহিদাা মোতাবেক ব্যবহার করা বা ব্যবহৃত অবস্থায় আছে। তাছাড়া সিজিপি ইয়ার্ডে যে করোনা স্বাস্থ্য সামগ্রী আছে তাও জানাননি ইয়ার্ড মাস্টার। বিষয়টি গোপন করে তিনি অপরাধ করেছেন। খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কিন্তু রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্যিক বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিজিপি ওয়াই ইয়ার্ডে প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টাকার করোনা স্বাস্থ্য সামগ্রী গোপন কক্ষে তালাবদ্ধ রাখার পেছনে চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার নাজমুল হোসাইন ও অতিরিক্ষ বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আনসার আলীও জানেন। এসব সামগ্রী আগে তাদের মাধ্যমে গোপন রাখার অনুরোধ করেছিলেন শাহনেওয়াজ স্যার।
কিন্তু তারা এসব সামগ্রী রাখতে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন। ফলে তাদের পরামর্শে আগ্রবাদ সিজিপি ওয়াই ইয়ার্ডের নিরপত্তা রক্ষীর কক্ষে এসব সামগ্রী গোপনে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। আর এসব সামগ্রী নিয়ে এখন চরম বেকায়দায় পড়েছেন ইয়ার্ড মাস্টার আবদুল মালেক। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল মাানুষ বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে অনেক চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি শাহনেওয়াজের সঙ্গে। রেলের ব্যবহৃত সরকারি নাম্বারটি এখন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাজমুল হোসাইনের হাতে। তাদের কাছে শাহনেওয়াজের ব্যক্তিগত নাম্বার চেয়েও পাওয়া যায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেক অনুসদ্ধান করেও তার কোনো একাউন্ট মেলেনি।
রেলওয়ের তথ্যমতে, আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) এএমএম শাহনেওয়াজকে বরখাস্ত করা হয়। ২৯ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এর আগে রেলের আভ্যন্তরীণ অডিটে কেনাকাটায় অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে।
সান নিউজ/আরআই