তুহিন খান, টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের মৃৎশিল্প উন্মুক্ত বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে হারিয়ে যেতে বসেছে। অত্যাধুনিক প্লাস্টিক, অ্যালুমোনিয়াম ও মেলামাইনের তৈজসপত্রের দাপটে এ শিল্প প্রায় বিলুপ্ত। ফলে জেলার প্রতিভাবান মৃৎশিল্পীরা অর্থাভাবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
জেলায় এক সময় তৈজসপত্রের চাহিদা পূরণ করত মাটির তৈরি হাড়ি, পাতিল, কলসি, থালা (সানকি), কুয়ার পাট, নানা ধরনের খেলনা, বিভিন্ন পিঠা তৈরির খরমা (সাজ) ইত্যাদি। গ্রাম্য মেলা ও হাট-বাজারে মাটির তৈরি ওইসব পণ্য শোভা পেত। মাটির তৈরি এসব পারিবারিক তৈজসপত্র বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থসম্মত ও সুস্বাদুপণ্যের আধার হিসেবে পরিগণিত। মাটির তৈরি উৎকৃষ্টমানের ওইসব তৈজসপত্রের স্থান দখল করে নিয়েছে অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক ও মেলামাইনের তৈরি তৈজসপত্র। গ্রামাঞ্চলের উৎসব-মেলা বা হাট-বাজারে প্রাকৃতিক উপাদানের তৈরি মৃৎশিল্পের পণ্য সামগ্রীর জায়গা নিয়েছে কৃত্তিমভাবে তৈরি তৈজসপত্র।
টাঙ্গাইল বিসিক সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ১৫৮টি কুমার পরিবার, বাসাইলে ১১৫টি, নাগরপুরে ১০৭টি, মির্জাপুরে ৯৯টি, দেলদুয়ারে ৬৫টি, ঘাটাইলে ৬০টি, ভূঞাপুরে ফলদা কুমার পাড়ায় ২২০টি, কালিহাতীতে ২৮০টি, গোপালপুরে ১১২টি, ধনবাড়ীতে ১০টি এবং মধুপুর উপজেলায় ৯টি কুমার পরিবার বসবাস করছে। জেলায় এক হাজার ২৩৫টি কুমার পরিবার থাকলেও তাদের অধিকাংশই পৈত্রিক পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মৃৎশিল্পীরা সুনিপূণ শৈল্পিকতায় তৈরি করছেন পুতুল, ফুলের টব, কুয়ার পাট, হাঁড়ি-পাতিল, খেলনা, শো-পিসসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় ও সৌখিন জিনিসপত্র। এসব পণ্য তারা শহরের দোকান এবং বাসা-বাড়িতে বিক্রি করে থাকেন। বর্তমান সামাজিকতায় মৃৎশিল্পের তৈজসপত্রের ব্যবহার চোখে পড়ে না, সৌখিন জিনিসপত্র এবং কুয়ার পাট তৈরিই মৃৎশিল্পীদের জীবিকার একমাত্র ভরসা।
মৃৎশিল্পীরা জানায়, নানা উৎসব-পার্বণে জেলার বিভিন্ন এলাকায় আয়োজিত মেলায় আগতরা সখের বসে মাটির তৈরি ব্যাংক, পুতুল, ঘোড়া ও গরুর গাড়ি, কারুকার্যকৃত ফুলদানী ইত্যাদি কিনে থাকে। করোনাকালে মেলার আয়োজনও বন্ধ থাকায় জেলার মৃৎশিল্পীরা কার্যত বেকার জীবন কাটিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তারা ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রসুলপুর জামাই মেলার আয়োজকদের অন্যতম ও গালা ইউপি চেয়ারম্যান রাজকুমার সরকার জানান, প্রায় দেড়শ বছরের ঐতিহ্য রসুলপুরের জামাই মেলা। এক সময় এ মেলার অন্যতম আয়োজন ছিল মাটির তৈরি তৈজসপত্র। জেলার মৃৎশিল্পীরা প্রতিবছর তাদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে মেলার আকর্ষন বাড়ানোর পাশাপাশি ক্রেতাদের কাছে টানতো। মাটির তৈরি জিনিস-পত্রের ব্যবহার কমে যাওয়ায় এখন হাতেগোনা কয়েকজন মৃৎশিল্পী নানা ধরনের খেলনা, ফুলদানী ও শো-পিস নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। মেলার মৃৎশিল্পের সে স্থান এখন কাঠের তৈরি ফার্নিচার দখল করে নিয়েছে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাসাখানপুরের চৈতি পাল, বাদল পাল, ঝর্ণা রাণী পাল, দেলদুয়ারের গমজানির নিমাই পাল, মির্জাপুরের গণেশ পাল, ভূঞাপুরের ফলদা কুমার পাড়ার পিয়াতা পাল, কালিহাতী উপজেলার স্বপন পাল, বাদল কুমার পালসহ অনেকেই জানান, মাটির তৈরি তৈজসপত্র এক সময় ঘর-গেরস্থালীর প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হত। এমনিতেই বর্ষাকালে মাটির তৈরি পণ্য রোদে শুকানো যায়না ও চুলায়(পুন/মুখাই/ভাটা) আগুন দেওয়া যায় না। এ কারণে মৃৎশিল্পীদের বছরের ৩-৪ মাস বেকার সময় কাটাতে হয়। বর্তমানে প্লাস্টিক, মেলামাইন ও অ্যালুমোনিয়ামের তৈজসপত্র সহজলভ্য হওয়ায় মাটির তৈরি পণ্যের ব্যবহার মৃৎ শিল্পের ভবিষ্যত ফিঁকে করে দিয়েছে। ফলে মৃৎ শিল্পীরা তাদের বাপ-দাদার পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। পৈত্রিক পেশাকে টিকিয়ে রাখতে জড়িতরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি করেন।
টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প নগরীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহনাজ বেগম বলেন, বিসিক থেকে সরকারি সহযোগিতায় মৃৎশিল্পীদের বিভিন্ন ধরনের কারিগরী ও আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয়। যে সব মৃৎশিল্পীরা শো-পিস তৈরি করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও ব্যাংক ঋণে সহযোগিতা করা হয়। তিনি আরও জানান, যারা মাটির তৈরি শো-পিস তৈরি করে থাকেন মেধা বাছাই করে তাদের মধ্য থেকে মেধাবীদের শিল্পভবনে তিন মাসের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবসা করার জন্য বিসিকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
সান নিউজ/কেটি