ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে অন্তত দেড়শ প্রতিষ্ঠানে ঝুলে আছে সরকারের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। ভ্যাটের এক হাজার ৪২টি রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় এই বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আদায় করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
চট্টগ্রাম কর আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি মো. সোলেমান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তার জন্য এনবিআর মাঠ পযার্য়ে কর আইনজীবী চালু করেছে। কর মামলার জটিলতা লাঘবে ৭ হাজার আইনজীবী মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। কিন্তু ভ্যাট সংক্রান্ত মামলা নিরসনের জন্য মাত্র ৭ জন ভ্যাট কন্সালটেন্ট নিয়োগ দিয়েছে। তাহলে মামলার জট কিভাবে লাঘব হবে? যে হারে ভ্যাট-সংক্রান্ত মামলা হচ্ছে, নিষ্পত্তির হার সে তুলনায় ধীরগতিতে হওয়ায় দিন দিন মামলার সংখ্যা বাড়ছেই।
কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাটর আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ১৯৯১ সালে প্রণীত ভ্যাট আইনের অস্পষ্টতা ও দুর্বলতা দূরীকরণে সময় লেগেছে ২৮ বছর। আবার ২০১৯ সালের জুলাইয়ে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হয়। বর্তমান ভ্যাটের নতুন আইনেও অস্পষ্টতা ও দুর্বলতা বিদ্যমান। তা দূরীভূত করতে কত বছর যে লাগবে তা প্রশ্নবিদ্ধ!
এরই মাঝে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে আরও অসংখ্য মামলা দায়ের করা হচ্ছে। কিন্তু এখনও কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনালের কোনো বিধি বা রুলস প্রণয়ন হয়নি। তাই ব্যবসায়ীরা কি করবে, কিভাবে মোকাবেলা করবে, কখন মামলা নিষ্পত্তি হবে, কত পরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে হবে, তা বোধগম্য নয়। এছাড়া আইনজীবী ও কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাটর কমিশনারেটদের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যায় ব্যবসায়ীরা এই নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সারাদেশ থেকে এই সংক্রান্ত মামলাগুলো দেশের একটি মাত্র কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনালে আসে। বিপুল পরিমাণ মামলার কারণে ট্রাইব্যুনাল দিন দিন ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তির জন্য মাত্র চারটি বেঞ্চ কাজ করে থাকে। এছাড়া কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট মামলার বিশেষজ্ঞ না থাকার কারণে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না। তাই মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট কমিশনারেটর সহকারী কমিশনার অনুরূপা দেব বলেন, যে হারে মামলা জমা হচ্ছে, সে হারে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। তাই প্রতিনিয়ত মামলার জট লেগে থাকছে। এছাড়া কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট দপ্তরের অধীনে ছিল কাস্টমস হাউস, কর বিভাগ, সিলেট অঞ্চল, বৃহত্তর চট্টগ্রাম। তাই মামলার সংখ্যা মাত্রারিক্তি বেশি। আবার ভ্যাট চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধীনে ১৯৯৬ সালের আগের মামলাও রয়েছে। কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাটর মামলাগুলো অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় পরিচালনা করে থাকে। হাইকোর্টে মামলাগুলো বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকে। ফলে শুনানি শেষে মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লেগে যায়।
অন্যদিকে, আপিল ট্রাইব্যুনালে রায় হয় দীর্ঘদিন পর। এসময়ে নতুন নতুন মামলা যুক্ত হচ্ছে। এভাবে মামলার জট তৈরি হচ্ছে। এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অধিকাংশ সময় মামলার নম্বরটি ছাড়া কোনো ডকুমেন্টও খুঁজে পাওয়া যায় না। এসময় যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের উপর মূসকের চাপ যেমন থাকে, তেমনি সরকারও রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয়। তবে কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট মামলা নিষ্পত্তিতে বদ্ধপরিকর হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগ।
এসি অনুরূপা দেব বলেন, আমাদের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) কার্যক্রমে আসার জন্যও অনেক ব্যবসায়ীকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে এডিআরে আসতে চায় না। এডিআরে আমরা এখন পর্যন্ত মোট ১৬টি মামলার নিষ্পত্তি করেছি। কিন্তু ব্যবসায়ীদের এডিআরে অনাগ্রহের কারণে বকেয়া রাজস্ব আদায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ভ্যাট দপ্তরের তথ্যমতে, নগরীর আগ্রাবাদ বিভাগ থেকে আপিল ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত আপিল মামলা রয়েছে ৪৮টি, হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা ২২২টি, সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন মামলা ১৪টি। এতে ২৮৪টি মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তাধীন রয়েছে ৭০২ কোটি ২১ লাখ ৮৯ হাজার ২৭২ টাকা।
চট্টলা বিভাগ থেকে আপিল ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত আপিল মামলা ১৯টি, হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা ২৫৫টি, সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন মামলা ৯টি। মোট ২৮৩টি মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তাধীন রয়েছে ২১৬ কোটি ৪৮ লাখ ৮৪ হাজার ৮৭৯ টাকা।
চান্দগাঁও বিভাগ থেকে আপিল ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত আপিল মামলা ৩১টি, হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা ১৪৭টি, সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন মামলা ২৪টি। মোট ২০২টি মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তাধীন রয়েছে ৫০৫ কোটি ৪৭ লাখ ৭ হাজার ৫০৫ টাকা।
পটিয়া বিভাগ থেকে আপিল ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত আপিল মামলা ৩০টি, হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা ৫৯টি, মোট ৮৯টি মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তাধীন রয়েছে ১৫১ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ টাকা।
কক্সবাজার বিভাগ থেকে আপিল ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত আপিল মামলা ১০টি, হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা ২২টি, সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন মামলা ১টি। মোট ৩৩টি মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তাধীন রয়েছে ৪৪ লাখ ৪ হাজার ৬৮২ টাকা।
রাঙামাটি বিভাগ থেকে আপিল ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত আপিল মামলা ৮টি, হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা ২০টি, সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন মামলা ১টি। মোট ২৯টি মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তাধীন রয়েছে ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ৩৬ হাজার ৫১৮ টাকা।
খাগড়াছড়ি বিভাগ থেকে আপিল ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত আপিল মামলা ৪টি, হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা ১১০টি, সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন মামলা ৪টি। মোট ১১৮টি মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তাধীন রয়েছে ৩০ লাখ ৯ হাজার ৯৮ টাকা।
বান্দরবান বিভাগ থেকে হাইকোর্টে দায়েরকৃত ৪টি রিট মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তাধীন রয়েছে ১৫ লাখ ৯৩৫ টাকা।
চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে মূল্য সংযোজন কর ভ্যাট-সংক্রান্ত আপিল ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত আপিল মামলা ১৫০টি, হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট মামলা ৮৩৯টি, সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন মামলা ৫৩টি। এসব মামলার বিপরীতে এনবিআরর রাজস্ব জড়িত এক কোটি ৯৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৫৫ টাকা।
তবে দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট পরিশোধ না করায় এসব মামলা হলেও ব্যবসায়ীদের পক্ষে একসাথে এতগুলো অর্থ পরিশোধ সম্ভব নয়- বলে জানিয়েছেন খাতুনগঞ্জে ইকবাল ট্রেডার্সর স্বত্বাধিকারী মো. ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, ভ্যাট গোয়েন্দার দল বিভিন্ন দলিলপত্র দাখিলের জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে তলব করে। এছাড়া দাখিল করা বার্ষিক সিএ রিপোর্ট, প্রতিবেদন, দাখিলপত্র (মূসক-১৯) এবং বিভিন্ন সময়ে ট্রেজারি চালান যাচাই করা হয়। তখনই ট্রেড আইডেন্টিটিফিকেশন নাম্বার (টিআইএন) দেখে গত ১০ থেকে ১৫ বছরের পুরাতন হিসাব নিকাশ টেনে ভ্যাট পরিশোধে লাখ টাকার পরিমাণ দায়ী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জরিমানা করে ভ্যাট কর্তৃপক্ষ। ব্যবসায়ীদের পক্ষে এত পরিমান টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তার সাথে চলতি মাসের ভ্যাটের টাকা পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া ভ্যাট জটিলতার কারণে প্রতিষ্ঠান যদি জরিমানা পরিশোধ করতে দেরি করে, তখন ব্যাংক হিসাব দেখে জরিমানা করা হয়।
সান নিউজ/কেটি